বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বিমান চলাচল শিল্পের কার্বন নিঃসরণ কমানোর প্রচেষ্টা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি ‘কল এভিয়েশন টু অ্যাকশন’ নামে একটি নতুন গঠিত সংগঠন এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছে।
তাদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় বিমান পরিবহন শিল্প ‘ভয়ঙ্করভাবে’ ব্যর্থ হচ্ছে।
সংগঠনটি জানাচ্ছে, বিমানের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ-সহ শিল্পটির মৌলিক রূপান্তর প্রয়োজন। তারা মনে করেন, কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের প্রযুক্তি এবং ক্রমবর্ধমান ফ্লাইটের চাহিদার ওপর অতি-নির্ভরশীলতার কারণে এই শিল্পে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা জরুরি।
তাদের মতে, এই শিল্প যদি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে বাইরের কঠোর নিয়ন্ত্রণের মুখে পড়তে পারে, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও তীব্র হবে।
সংগঠনটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, এবং একসময় ডাচ এয়ারলাইন্স কেএলএম-এর সাসটেইনেবিলিটি বিভাগের ভাইস- প্রেসিডেন্ট কারেল বকস্টায়েল বলেন, “আমরা বিমান চলাচলের ভালো দিকগুলো দেখি, তবে একইসঙ্গে এর পরিবর্তনও জরুরি।
বিশ্বজুড়ে ইতিবাচক অবদান রাখতে হলে এই শিল্পের নতুন করে পথ খুঁজে বের করতে হবে।”
বিমান চলাচল শিল্পের কার্বন নিঃসরণ একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা, যা বিভিন্ন দেশের জাতীয় পরিকল্পনা থেকে বাইরে থাকে।
জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক সংস্থা, আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা (আইকাও)-কে এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হয়।
বকস্টায়েলের মতে, আইকাও এক্ষেত্রে ‘ভয়ঙ্করভাবে’ ব্যর্থ হয়েছে।
তিনি বলেন, “আলোচনার আট বছর পর, তারা কেবল ‘কর্সিয়া’ নামের একটি স্কিম তৈরি করেছে, যা মূলত কার্বন অফসেটের ব্যবস্থা।
এর মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করার পরে, বিমানের কার্বন নিঃসরণের সমস্যা অন্য শিল্পের ওপর চাপানো হচ্ছে।”
এই স্কিমটি ‘অস্পষ্ট’ এবং ‘সমস্যাপূর্ণ’ হিসেবে সমালোচিত হয়েছে।
এখনো পর্যন্ত কোনো এয়ারলাইন্সকে কার্বন ক্রেডিট ব্যবহারের জন্য চাপ দেওয়া হয়নি।
বকস্টায়েল আরও বলেন, “আমরা যদি এখনই ব্যবস্থা না নিই, তাহলে ২০৫০ সাল নাগাদ মানুষের সৃষ্ট মোট কার্বন নিঃসরণের এক-চতুর্থাংশ আসবে বিমান চলাচল শিল্প থেকে।
এটা খুবই লজ্জাজনক হবে।”
তিনি যোগ করেন, “আমরা উড়োজাহাজের এই জাদুকে ভালোবাসি, তবে এর ধ্বংসও দেখতে পাচ্ছি।
আমরা সেটিই আটকাতে চাই।
আমরা আশা করি, আমাদের এই উদ্যোগ বিমান পরিবহন শিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেক মানুষকে কথা বলতে উৎসাহিত করবে, কারণ আমরা মনে করি, তাদের একটা বড় অংশ এখনো নীরব রয়েছেন।
এই নীরবতা ভাঙা দরকার এবং শিল্পের নেতাদের এই পরিবর্তনে অংশ নিতে উৎসাহিত করতে হবে।”
বর্তমানে, বিশ্বের মাত্র ১ শতাংশ মানুষ বিমান চলাচলে নির্গত কার্বনের ৫০ শতাংশের জন্য দায়ী।
ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকার-এর মতে, এই শিল্পের জলবায়ু পরিকল্পনা ‘পর্যাপ্ত নয়’।
আইকাও-এর ধারণা অনুযায়ী, ২০৪২ সাল নাগাদ যাত্রী সংখ্যা দ্বিগুণ হতে পারে।
যদিও, তারা আরও কার্যকর বিমান, টেকসই জ্বালানি এবং ‘কর্সিয়া’-র মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিমান চলাচলে কার্বন নিঃসরণ কমানোর যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া হচ্ছে, তা যাত্রী সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ার কারণে সৃষ্ট কার্বনের পরিমাণ কমাতে যথেষ্ট নয়।
এমনকি জ্বালানি-সাশ্রয়ী প্রযুক্তির উন্নতিও এখন থমকে গেছে।
কাতার এয়ারওয়েজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ২০২৩ সালে এয়ারলাইন্স শিল্পের কার্বন নিঃসরণ লক্ষ্যকে ‘লোক দেখানো’ বলে মন্তব্য করেছিলেন।
এই পরিস্থিতিতে ‘কল এভিয়েশন টু অ্যাকশন’ মনে করে, বিমান পরিবহন শিল্পকে বিজ্ঞান-ভিত্তিক কার্বন বাজেট অনুযায়ী নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।
একইসঙ্গে জলবায়ু নীতিমালার বিরোধিতা বন্ধ করতে হবে।
এছাড়াও, ফ্লাইট ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফ্লাইটের চাহিদা নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার।
বকস্টায়েল আরও যোগ করেন, কার্বন নিঃসরণ কমানোর প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে টিকিটের দাম বাড়তে পারে।
তাই, যাত্রী সংখ্যাকে সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ফ্লাইট বা কার্বন ট্যাক্সের মতো অতিরিক্ত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন হতে পারে।
এয়ারস্পেস প্রকৌশলী এবং ‘সেফ ল্যান্ডিং’-এর সদস্য ফিনলে এশার মনে করেন, “প্রকৌশলী হিসেবে, ‘কল এভিয়েশন টু অ্যাকশন’-এর প্রস্তাবনাগুলো নতুন উদ্ভাবনের দিকে নিয়ে যাবে—নতুন বিমানের নকশা, কার্বন-শূন্য শক্তির নতুন রূপ এবং বিমানবন্দরের নতুন বিন্যাস তৈরি হবে।
এর ফলে শুধু কর্মসংস্থানই বাড়বে না, বরং আকাশ ভ্রমণ আরও সবুজ, পরিচ্ছন্ন, শান্ত এবং সবার জন্য সহজলভ্য হবে।”
তথ্যসূত্র: The Guardian