ভবন নির্মাণে প্রকৃতির উপাদান: বর্জ্য থেকে সম্পদ তৈরির এক নতুন দিগন্ত
বিশ্বজুড়ে পরিবেশ দূষণ আর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে টেকসই উন্নয়নের ধারণাটি এখন সময়ের দাবি। কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে পরিবেশবান্ধব উপায়ে আধুনিক স্থাপত্য নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে।
এই লক্ষ্যে, লন্ডনের ‘মেটেরিয়াল কালচার্স’ নামের একটি ডিজাইন স্টুডিও নতুন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তারা প্রকৃতির উপাদান ব্যবহার করে বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করার এক অভিনব কৌশল নিয়ে কাজ করছে।
মেটেরিয়াল কালচার্সের প্রতিষ্ঠাতা, পালােমা গর্মলে এবং তার সঙ্গীরা প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে নির্মাণ সামগ্রী সংগ্রহ করেন। তাদের মূল ভাবনা হলো, গাছের প্রতিটি অংশের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা।
গাছের বাকল থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক আঠা ও রেজিন – কোনো কিছুই যেন অপচয় না হয়, সেদিকে তাদের খেয়াল। বর্তমানে লন্ডনের ভিএন্ডএ মিউজিয়ামে তাদের ‘উডল্যান্ড গুডস’ নামে একটি প্রদর্শনী চলছে।
সেখানে গাছের বাকল থেকে তৈরি আসবাবপত্র, পাইন গাছের পাতা ও রস থেকে তৈরি উপাদান, শুকনো শ্যাওলা দিয়ে সজ্জিত বার্চ গাছের বাকলের মতো নানান উদ্ভাবনী জিনিস উপস্থাপন করা হয়েছে।
সাধারণত নির্মাণশিল্পে গাছের বাকলকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। সেটিকে ফেলে দেওয়া হয় অথবা সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
কিন্তু মেটেরিয়াল কালচার্স দেখিয়েছে কিভাবে এই বাকলকে বিভিন্ন কাজে লাগানো যায়। তারা পরীক্ষামূলকভাবে গাছের আঠা ব্যবহার করে গাছের বাকলকে চাপ দিয়ে স্তর তৈরি করে পাতলা প্লেটের মতো তৈরি করছে।
এর ফলে বাইরের আবরণের জন্য উপযুক্ত উপাদান তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। তারা প্রমাণ করেছে যে, গাছের বাকল থেকে তৈরি উপাদান বৃষ্টিরোধী এবং অগ্নিনির্বাপক হিসেবেও কাজ করতে পারে।
মেটেরিয়াল কালচার্সের সদস্যরা মনে করেন, পরিবেশের ক্ষতি কমাতে হলে স্থাপত্য এবং কৃষির মধ্যে সম্পর্ক পুনরায় স্থাপন করতে হবে। তাদের মতে, ভবনগুলোকে অবশ্যই স্থানীয় পরিবেশ থেকে উপাদান সংগ্রহ করতে হবে।
বর্তমানে যুক্তরাজ্যের মোট কার্বন নিঃসরণের ৪০ শতাংশের বেশি আসে নির্মাণশিল্প থেকে। তাই তারা চান সরবরাহ শৃঙ্খল আরও স্বচ্ছ এবং স্থানীয় হোক।
তাদের এই ধারণার বাস্তব রূপ দিতে, উত্তর লন্ডনের উড গ্রিনে তারা একটি কমিউনিটি ফুড গ্রোইং হাব তৈরি করেছেন। এখানে তিনটি বার্ন-আকৃতির শেড তৈরি করা হয়েছে।
এর মধ্যে একটি কমিউনিটি হল, অন্যটিতে শ্রেণীকক্ষ এবং অফিস, এবং তৃতীয়টিতে একটি কর্মশালা ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র রয়েছে।
হালকা ওজনের কাঠের কাঠামো, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত খড়ের গাঁট দিয়ে তৈরি দেওয়াল, এবং মাটি, বালি ও চক দিয়ে প্লাস্টার করে ভবনগুলো তৈরি করা হয়েছে। মেঝে তৈরি করা হয়েছে ফোমযুক্ত কাঁচ থেকে পুনর্ব্যবহৃত ইনসুলেশন ব্যবহার করে।
ভেতরের দেওয়াল তৈরি করা হয়েছে ‘স্টকস’ নামের মাটি, খড় এবং কাদামাটি দিয়ে তৈরি ব্লক ব্যবহার করে।
এই প্রকল্পে স্থানীয় ‘উবেলে ইনিশিয়েটিভ’ এবং ‘অর্গানিক লী’ নামক দুটি সংস্থার সদস্যরাও জড়িত ছিলেন। তারা খড়ের গাঁট তৈরি থেকে শুরু করে দেয়াল গাঁথা ও প্লাস্টারের কাজ করেছেন।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে একদিকে যেমন কার্বন নিঃসরণ কমানো সম্ভব হয়েছে, তেমনই স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং নির্মাণ খরচও উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো গেছে।
পাশাপাশি, এই ডিজাইন স্টুডিও ‘পাস্তুর গার্ডেনস’-এ একটি ছোট কুটির তৈরি করেছে। সেখানে হালকা মাটি এবং খড় ব্যবহার করে দেয়াল তৈরি করা হয়েছে।
কুটিরটির বাইরের অংশে আচ্ছাদন হিসেবে খড়ের ব্যবহার করা হয়েছে। তারা এই ধরনের পরিবেশ-বান্ধব বাড়ি তৈরির পরিকল্পনা সবার জন্য উন্মুক্ত করতে চায়।
মেটেরিয়াল কালচার্স এখন একটি ‘ল্যান্ড ল্যাব’ তৈরির পরিকল্পনা করছে, যেখানে তারা গাছপালা থেকে নির্মাণ সামগ্রী তৈরির বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেবে।
তাদের লক্ষ্য হলো, কৃষি এবং নির্মাণ পদ্ধতির মধ্যে সমন্বয় ঘটানো। তারা চান, মানুষ যেন টেকসই উপায়ে ভবন নির্মাণ করতে পারে।
তাদের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হতে পারে। আমাদের দেশেও স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব ভবন নির্মাণের সম্ভাবনা রয়েছে, যা একদিকে যেমন পরিবেশের সুরক্ষা করবে, তেমনি নির্মাণ খরচও কমাতে সহায়ক হবে।
তথ্য সূত্র: The Guardian