ভবিষ্যতের উড়ান: কার্বনমুক্ত বিমানের স্বপ্ন আর বাস্তবতার হাতছানি
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে যখন জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট বাড়ছে, তখন বিমান চলাচলে কার্বন নিঃসরণ কমানোর প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে টেকসই জ্বালানির অনুসন্ধান তাই এখন সময়ের দাবি।
সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা এক অভিনব উপায় খুঁজে বের করেছেন—যা কিনা বাতাস থেকে সরাসরি জ্বালানি তৈরি করতে পারে। এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির নাম ‘ই-ফুয়েল’ বা ‘বৈদ্যুতিক জ্বালানি’। আসুন, এই নতুন দিগন্তের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।
ই-ফুয়েল কী?
ই-ফুয়েল হলো এক ধরনের সিনথেটিক জেট ফুয়েল, যা কার্বন ডাই অক্সাইড (CO₂) এবং হাইড্রোজেন (H₂) থেকে তৈরি করা হয়। এই হাইড্রোজেন তৈরি করতে বিদ্যুতের মাধ্যমে পানিকে বিশ্লেষণ (electrolysis) করা হয়, যা সাধারণত নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আসে।
এই প্রক্রিয়ায় বাতাস থেকে কার্বন সংগ্রহ করে তা বিমানের জ্বালানিতে রূপান্তর করা সম্ভব। এর ফলে কার্বন নিঃসরণ প্রায় শূন্যের কোঠায় আনা যেতে পারে।
সুবিধা ও সম্ভাবনা
ই-ফুয়েলের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি কার্বন নিরপেক্ষ হতে পারে। অর্থাৎ, এই জ্বালানি ব্যবহারের ফলে পরিবেশে নতুন করে কার্বন যোগ হবে না। এছাড়াও, ই-ফুয়েল তৈরিতে খাদ্য উৎপাদন বা জমির ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হয় না, যা বায়ো-ডিজেল বা অন্যান্য জৈব জ্বালানির ক্ষেত্রে একটি বড় সীমাবদ্ধতা।
বিদ্যমান বিমান ইঞ্জিনগুলোতেও এই জ্বালানি ব্যবহার করা সম্ভব, ফলে নতুন করে বিমানের প্রযুক্তি পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে না।
খরচ এবং চ্যালেঞ্জ
যদিও ই-ফুয়েলের সম্ভাবনা অনেক, এর উৎপাদন এখনো বেশ ব্যয়বহুল। কার্বন সংগ্রহ এবং হাইড্রোজেন উৎপাদনের উচ্চ খরচ এর প্রধান কারণ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এভিয়েশন সেফটি এজেন্সির (European Union Aviation Safety Agency) তথ্যমতে, বর্তমানে ই-ফুয়েলের প্রতি টনের দাম প্রায় ৭,৬৯৫ ইউরো (প্রায় ৯ লক্ষ টাকার বেশি)।
যেখানে প্রচলিত জেট ফুয়েলের দাম প্রতি টন মাত্র ৭৩৪ ইউরো (প্রায় ৮৩ হাজার টাকা)। বায়ো-বেজড্ এসএএফ (SAF) বা জৈব জ্বালানির দামও ই-ফুয়েলের চেয়ে কম, প্রায় ২,০৮৫ ইউরো (প্রায় ২ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকা)।
উৎপাদন প্রক্রিয়া
ই-ফুয়েল তৈরির মূল প্রক্রিয়াটি হলো কার্বন ডাই অক্সাইড সংগ্রহ এবং হাইড্রোজেন উৎপাদন। কার্বন সংগ্রহের জন্য বাতাস থেকে সরাসরি CO₂ শুষে নেওয়া হয় অথবা শিল্পকারখানার নির্গমন থেকে তা সংগ্রহ করা হয়। এরপর, বিদ্যুতের সাহায্যে পানিকে ভেঙে হাইড্রোজেন তৈরি করা হয়।
ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক একটি কোম্পানি, টুয়েলভ (Twelve), কম তাপমাত্রায় কার্বন ডাই অক্সাইড বিশ্লেষণ করার একটি পদ্ধতি তৈরি করেছে, যা প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে বেশি পরিবেশবান্ধব।
বাস্তবায়নের পথে
বর্তমানে ই-ফুয়েলের বাজার এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তবে, বিভিন্ন এয়ারলাইন্স এবং প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো এই খাতে বিনিয়োগ করছে। ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স, আইএজি (ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের মূল কোম্পানি), মাইক্রোসফটসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান এই প্রযুক্তির উন্নয়নে কাজ করছে।
২০৩০ সাল নাগাদ ই-ফুয়েলের বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে উড়োজাহাজে ২% এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ৭০% টেকসই জ্বালানি ব্যবহার করতে হবে, যার মধ্যে ই-ফুয়েলের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ থাকবে।
বাংলাদেশের জন্য এর প্রভাব
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ একটি ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। তাই, বিশ্বজুড়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর এই উদ্যোগে বাংলাদেশেরও সমর্থন জানানো উচিত।
ভবিষ্যতে যদি ই-ফুয়েলের উৎপাদন বাড়ে, তবে তা বাংলাদেশের বিমান সংস্থাগুলোর জন্য একটি বিকল্প জ্বালানি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যদিও এখনই এই প্রযুক্তি পুরোপুরিভাবে ব্যবহারের মতো অবস্থায় আসেনি, তবে গবেষণা, উন্নয়ন এবং নীতিগত সমর্থন এর অগ্রগতিতে সহায়তা করবে।
উপসংহার
ই-ফুয়েল প্রযুক্তি নিঃসন্দেহে বিমানের জ্বালানি খাতে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে। তবে, এর সফলতার জন্য প্রয়োজন সরকারি নীতি সমর্থন, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং বিনিয়োগ। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ২০৩০ সালের মধ্যে এই জ্বালানি আরও সাশ্রয়ী হবে এবং আকাশ পথে কার্বন নিঃসরণ কমানোর স্বপ্ন পূরণ হবে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন