শিকারের কৌশল: কীভাবে বাদুড়েরা গোপনে শোনে?

বাদুড়ের শ্রবণ-ক্ষমতা: খাবার খুঁজে বের করার এক অভিনব কৌশল।

প্রকৃতিতে টিকে থাকার জন্য প্রাণীদের লড়াই চলে অবিরাম। খাদ্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে আত্মরক্ষা—প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের প্রয়োজন হয় বিশেষ দক্ষতা।

পানামার গভীর অরণ্যে এমনই এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটে, যেখানে বাদুড়েরা তাদের শ্রবণ ক্ষমতার মাধ্যমে শিকার খুঁজে বের করে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কীভাবে এই বাদুড়েরা “শুনে শেখার” মাধ্যমে নিজেদের জীবন ধারণের কৌশল তৈরি করেছে।

পানামার বর্ষাকালে জঙ্গলে ব্যাঙের ডাক শোনা যায়, বিশেষ করে টোঙ্গারা প্রজাতির ব্যাঙেরা তাদের সঙ্গীদের আকৃষ্ট করতে জোরে শব্দ করে। এই সময়ে ব্যাঙেরা থাকে এক বিপদের মধ্যে—কারণ তাদের এই শব্দই ডেকে আনে একদল ক্ষুধার্ত বাদুড়কে।

কিন্তু বাদুড়ের শ্রবণ ক্ষমতা এতটাই সূক্ষ্ম যে, তারা কেবল শব্দ শুনেই বুঝতে পারে কোনটি তাদের খাদ্য আর কোনটি বিষাক্ত।

ফ্রিঞ্জ-লিপড্ (fringe-lipped) নামক এক প্রজাতির বাদুড়, যাদের মুখমণ্ডলের চারপাশে লোমশ অংশ থাকে, তারা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে পারদর্শী। এরা ব্যাঙ ও অন্যান্য উভচর প্রাণীর ডাক শুনে তাদের খাদ্যযোগ্যতা সম্পর্কে ধারণা লাভ করে।

সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, বয়স্ক বাদুড়ের তুলনায় অল্পবয়সী বাদুড়দের মধ্যে এই বিচার ক্ষমতা কম থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, অল্পবয়সী বাদুড়েরা বিষাক্ত ব্যাঙের ডাকেও প্রতিক্রিয়া দেখায়, যেখানে বয়স্ক বাদুড়েরা থাকে নির্বিকার।

এই গবেষণার প্রধান লেখক, ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক লোগান জেমস বলেন, “এর থেকে বোঝা যায়, অল্পবয়সী বাদুড়দের সম্ভবত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখতে হয় যে কোন ডাক তাদের জন্য নিরাপদ।

জার্মানির হামবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনীয় আচরণবিদ্যার অধ্যাপক মিরিয়াম ক্নোরনশিল্ড (যিনি এই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন না) মনে করেন, “এটি একটি চমৎকার উদাহরণ যে কীভাবে আচরণ অভিজ্ঞতা ও শিক্ষার দ্বারা প্রভাবিত হয়।

প্রায় ১৭ বছর আগে, স্মিথসোনিয়ান ট্রপিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী র‍্যাচেল পেজ এই গবেষণা শুরু করেন। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, বাদুড়েরা জন্মগতভাবে এই ক্ষমতা নিয়ে আসে, নাকি তারা পরিবেশ থেকে শেখে।

পেজ ও তার দল ১৫টি ভিন্ন প্রজাতির ব্যাঙ ও অন্যান্য উভচরের ডাক সংগ্রহ করেন। এরপর তারা বন্য পরিবেশে অল্পবয়সী ও বয়স্ক বাদুড়দের খাঁচায় রেখে তাদের প্রতিক্রিয়ার ভিডিও ধারণ করেন।

বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেন, উভয় দলের বাদুড়ই খাদ্য হিসেবে উপযুক্ত আকারের ব্যাঙের ডাকে সাড়া দেয়। তবে, কিছু অল্পবয়সী বাদুড় টোঙ্গারা ব্যাঙের ডাকে তেমন আগ্রহ দেখায়নি, যা তাদের খাদ্য।

এমনকি কিছু অল্পবয়সী বাদুড় বিষাক্ত ব্যাঙের ডাকের দিকে আকৃষ্ট হয়ে খাঁচার দিকে ছুটে আসে বা আক্রমণাত্মক আচরণ করে।

গবেষক লোগান জেমস বলেন, “যেসব অল্পবয়সী বাদুড় বিষাক্ত ব্যাঙের ডাকে এত তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়, তা প্রমাণ করে যে সময়ের সাথে সাথে তারা তাদের কৌশল পরিবর্তন করে।

নতুন গবেষণায় এটাও স্পষ্ট যে, সম্ভবত মায়ের কাছ থেকেও তারা এই বিষয়ে শিক্ষা লাভ করে। কারণ, বাদুড়ছানা মায়ের সাথেই অনেক দিন পর্যন্ত থাকে, যা তাদের সামাজিক শিক্ষার সুযোগ করে দেয়।

অতীতে পেজের গবেষণাগারে বাদুড়দের কিছু বিশেষ শব্দ (রিংটোন) চিহ্নিত করতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, বাদুড়েরা চার বছর পর্যন্ত সেই শব্দের সাথে তাদের সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে।

এই গবেষণা থেকে বোঝা যায়, বাদুড়েরা কীভাবে তাদের শ্রবণ ক্ষমতার মাধ্যমে পরিবেশ থেকে সংকেত গ্রহণ করে এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়। গবেষকদের মতে, বাদুড়ের এই ক্ষমতা মানুষেরও রয়েছে।

মানুষের ক্ষেত্রেও আমরা আমাদের নাম শুনলে যেমন দ্রুত সাড়া দিই, তেমনি বাদুড়েরা তাদের প্রয়োজনীয় শব্দগুলো আলাদা করতে শেখে।

ভবিষ্যতে গবেষকরা বিভিন্ন ধরনের ব্যাঙ ও অন্যান্য প্রাণীর ডাকের মিশ্রণে বাদুড়দের প্রতিক্রিয়া এবং বন্য পরিবেশে তাদের শিকারের আচরণ নিয়ে আরও গবেষণা করার পরিকল্পনা করছেন।

তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *