ভয়ংকর ঝড়ে ডুবে গেল বিলাসবহুল ‘বেয়েসিয়ান’ সুপারইয়ট, তদন্তে উঠে এল চাঞ্চল্যকর তথ্য।
গত আগস্ট মাসে ইতালির উপকূলের কাছে ভয়াবহ ঝড়ে ডুবে যাওয়া বিলাসবহুল ‘বেয়েসিয়ান’ সুপারইয়টের দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তীব্র বাতাসের কারণে ইয়টটি ডুবে যায় এবং এর নকশার কিছু দুর্বলতা ছিল যা মালিক বা ক্রু-দের জানা ছিল না।
ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় ব্রিটিশ টেকনোলজি ব্যবসায়ী মাইক লিনচ এবং তার ১৮ বছর বয়সী মেয়ে হান্নাসহ সাতজনের মৃত্যু হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঘটনাটি ঘটেছিল ইতালির সিসিলি দ্বীপের পোর্টিকেলো বন্দরের কাছে।
লিনচের মালিকানাধীন ১৮৪ ফুট লম্বা বেয়েসিয়ান ইয়টটি তীরে ভেড়ানো ছিল।
ঘটনার দিন সন্ধ্যায় আবহাওয়া শান্ত ছিল, হালকা বাতাস বইছিল।
কিন্তু আবহাওয়ার পূর্বাভাসে ঝড়ের পূর্বাভাস ছিল।
ইয়টের ক্যাপ্টেন জেমস কাটফিল্ড রাতের কর্মীদের সতর্ক করে বলেছিলেন, বাতাসের গতি ঘণ্টায় ২৩ মাইলের বেশি হলে বা ইয়টের অ্যাঙ্কর (নৌঙর) স্থানচ্যুত হলে যেন তাকে জানানো হয়।
ভোররাতের দিকে, প্রায় ৩টার দিকে একজন কর্মী ঝড়ের ঘন মেঘ এবং বিদ্যুতের ঝলকানি দেখতে পান।
যদিও তখন বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় প্রায় ৯ মাইল।
এর কিছুক্ষণ পরেই, বাতাসের বেগ বেড়ে ঘণ্টায় ৩৪ মাইলে পৌঁছায়।
ভোর ৩টা ৫৫ মিনিটে, ওই কর্মী ঝড়ের একটি ভিডিও তৈরি করে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেন।
এরপর তিনি ইয়টের ভেতরের অংশ বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে ককপিটের জানালা এবং সামনের হ্যাচগুলো বন্ধ করে দেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ঝোড়ো হাওয়ার সাথে ভয়ংকর গতিতে বাতাস বইতে শুরু করে, যা ঘূর্ণিঝড়ের মতো রূপ নেয়।
এরপর ভোর ৩টা ৫৭ মিনিটে ইয়টের অ্যাঙ্কর স্থানচ্যুত হয়।
সাথে সাথে কর্মীদের ঘুম ভাঙানো হয়।
লিনচ তখন ইয়টের ফ্লাইব্রিজে যান, সম্ভবত সকাল ৮টার জন্য ট্যাক্সি বাতিল করতে হবে কিনা তা দেখতে।
এরই মধ্যে ইয়টের রাঁধুনি থালা-বাসন গোছাতে শুরু করেন।
কিন্তু এর কিছুক্ষণ পরেই, হঠাৎ করে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৮০ মাইলের বেশি হয়ে যায়।
এর কিছুক্ষণের মধ্যেই, অর্থাৎ ভোর ৪টা ৬ মিনিটে ইয়টটি “হিংস্রভাবে” একদিকে কাত হতে শুরু করে এবং ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে ৯০ ডিগ্রি কোণে হেলে পড়ে।
এর ফলে ডেকে থাকা মানুষজন, আসবাবপত্র এবং অন্যান্য জিনিসপত্র একদিকে ছিটকে পড়তে থাকে।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ইয়টের ভেতরে জল প্রবেশ করার আগে পর্যন্ত কোনো সমস্যা দেখা যায়নি।
কিন্তু এরপরই স্টারবোর্ড রেলিংয়ের ওপর দিয়ে জল প্রবেশ করে এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সিঁড়িগুলো দিয়ে ইয়টের অভ্যন্তরে জল ঢুকতে শুরু করে।
এরপর সেখানে থাকা যাত্রী ও ক্রুরা দ্রুত বিপদ থেকে বাঁচতে চেষ্টা করেন।
কিছু যাত্রী তাদের কেবিন থেকে বের হওয়ার জন্য আসবাবপত্রের ড্রয়ার ব্যবহার করেন।
ইয়ট থেকে বাঁচতে সক্ষম হওয়া ব্যক্তিরা জলের ওপর ভেসে ছিলেন এবং ইয়টের কুশন ব্যবহার করে কোনোমতে নিজেদের টিকিয়ে রেখেছিলেন।
এরপর ইয়টের চিফ অফিসার একটি লাইফ র্যাফ্ট (ভেলা) আলাদা করতে সক্ষম হন এবং সেটি ফুলিয়ে ফেলেন।
কাছে থাকা একটি জাহাজের ক্যাপ্টেন লাইফ র্যাফ্টের আলো দেখে দ্রুত সেখানে যান এবং জীবিতদের উদ্ধার করেন।
পরে তিনি স্থানীয় কোস্ট গার্ডকে খবর দেন।
দুর্ঘটনায় ইয়টের রাঁধুনি রিকার্ডো থমাস, মরগান স্ট্যানলি ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক জোনাথন ব্লুমার, বিশিষ্ট আমেরিকান আইনজীবী ক্রিস মরভিলো এবং তাদের স্ত্রী জুডি ব্লুমার ও নেদা মরভিলোসহ সাতজনের মৃত্যু হয়।
ক্যাপ্টেন কাটফিল্ড ও লিনচের স্ত্রী অ্যাঞ্জেলা বাকারেসহ আরও ১৪ জন এই দুর্ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যান।
তদন্তে দেখা গেছে, ঘণ্টায় প্রায় ১১৭ কিলোমিটার (৭৩ মাইল) বেগে বাতাস বইলেই বেয়েসিয়ান ইয়টটি নিয়ন্ত্রণ হারায়।
রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ইয়টটি হয়তো সামান্য বাতাসেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারতো।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “এই দুর্বলতাগুলো (যখন ইয়টটি ইঞ্জিনচালিত অবস্থায় ছিল, পালগুলো নামানো ছিল এবং বোর্ডে ১০% ব্যবহারযোগ্য জিনিস ছিল) ইয়টের স্থিতিশীলতা সংক্রান্ত তথ্যের বইতে চিহ্নিত করা হয়নি।
ফলস্বরূপ, বেয়েসিয়ানের মালিক বা ক্রু কেউই এই দুর্বলতা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না।
বর্তমানে মেরিন সালভেজ বিশেষজ্ঞরা সমুদ্র থেকে ইয়টটি উদ্ধারের চেষ্টা করছেন, যাতে দুর্ঘটনার সঠিক কারণ আরও ভালোভাবে জানা যায়।
তথ্য সূত্র: সিএনএন