**বেলারুশে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি: যুক্তরাষ্ট্র-বেলারুশ সম্পর্ক উন্নয়নের ইঙ্গিত?**
বেলারুশ সরকার সম্প্রতি বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা সিয়ের্হাই তিখানোভস্কি এবং আরও ১৩ জন রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দিয়েছে। বিরোধী নেত্রী স্বেতলানা তিখানোভস্কায়ার দল শনিবার এই খবর জানায়। জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার বিরল বেলারুশ সফরের পরেই এই মুক্তি মিলেছে।
২০২০ সালে কারারুদ্ধ হওয়া তিখানোভস্কি একজন জনপ্রিয় ব্লগার ও সমাজকর্মী ছিলেন। তাঁর স্ত্রী স্বেতলানা তিখানোভস্কায়া বর্তমানে নির্বাসনে রয়েছেন। তাঁর দল জানিয়েছে, মুক্তি পাওয়ার পর তিখানোভস্কি আরও ১৩ জন রাজনৈতিক বন্দীর সঙ্গে লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিয়াসে পৌঁছেছেন। মুক্তির কয়েক ঘণ্টা আগে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো’র সঙ্গে ইউক্রেনের জন্য নিযুক্ত মার্কিন দূত কিথ কেলোগের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
উল্লেখ্য, কেলোগ ছিলেন বিগত কয়েক বছরে বেলারুশ সফর করা সর্বোচ্চ পদধারী মার্কিন কর্মকর্তা।
তিখানোভস্কায়ার অফিসিয়াল টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, তিখানোভস্কি একটি সাদা মিনিবাস থেকে নামছেন। মাথায় তাঁর চুল কামানো ছিল, শরীর ছিল দুর্বল। তারপরও তিনি হাসছিলেন। এরপর তিনি তাঁর স্ত্রীকে দীর্ঘ আলিঙ্গন করেন, যেখানে তাঁদের সমর্থকেরা করতালি দিচ্ছিলেন।
স্বেতলানা তিখানোভস্কায়া সাংবাদিকদের বলেন, “আমার স্বামী মুক্তি পেয়েছেন। হৃদয়ে যে আনন্দ, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।” তবে তিনি আরও যোগ করেন, বেলারুশে এখনও ১,১০০ জনের বেশি রাজনৈতিক বন্দী কারাগারে বন্দি রয়েছেন, তাই তাঁদের দলের কাজ এখনও শেষ হয়নি।
তিখানোভস্কি, যিনি “আরশোলা থামাও” (stop the cockroach) স্লোগানের জন্য পরিচিত ছিলেন, ২০২০ সালের নির্বাচনে লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দেওয়ার পরেই কারারুদ্ধ হন। তাঁর গ্রেপ্তারের পর, তাঁর স্ত্রী স্বেতলানা তাঁর হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। যদিও নির্বাচনের ফলকে বিরোধী দল এবং পশ্চিমা দেশগুলো প্রহসন হিসেবে আখ্যা দেয়।
২০২০ সালের নির্বাচনের পর ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। সেই সময় নিরাপত্তা বাহিনী কঠোর হাতে পরিস্থিতি দমন করে। প্রতিবাদকারীদের ওপর দমন-পীড়নে প্রায় ৩৫,০০০ জনকে আটক করা হয়েছিল। অনেক বিরোধী নেতা হয় দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, না হয় কারাগারে বন্দী হন। তিখানোভস্কিকে গণ-দাঙ্গা সংগঠিত করার অভিযোগে সাড়ে ১৯ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে লুকাশেঙ্কো সপ্তম মেয়াদে ক্ষমতায় আসেন, যা বিরোধী দল প্রহসন হিসেবে উল্লেখ করে। জানা গেছে, পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতের উদ্দেশ্যে লুকাশেঙ্কো জুলাই ২০২৪ সাল থেকে প্রায় ৩০০ জনকে ক্ষমা করেছেন, যাদের মধ্যে মার্কিন নাগরিকও ছিলেন।
মিনস্কে অনুষ্ঠিত বৈঠকে লুকাশেঙ্কো কেলোগ এবং মার্কিন প্রতিনিধি দলকে স্বাগত জানান। তিনি বলেন, “আমি সত্যিই আশা করি আমাদের আলোচনা আন্তরিক ও খোলামেলা হবে। অন্যথায়, আলোচনার কোনো মানে নেই। যদি আমরা একে অপরের সঙ্গে চালাকি করি, তবে কোনো ফল পাওয়া যাবে না।”
লুকাশেঙ্কোর প্রেস সচিব নাতালিয়া আইসমন্ট পরে রুশ গণমাধ্যমকে জানান, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুরোধের পরেই তিনি ১৪ জন বন্দীকে মুক্তি দিয়েছেন।
মার্কিন কর্মকর্তা কেলোগের এই সফর বেলারুশের ওপর আরোপিত কিছু মার্কিন নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতে পারে কিনা, তা এখনো স্পষ্ট নয়। উল্লেখ্য, ২০২০ সালের বিক্ষোভের সময় দমন-পীড়ন এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনে বেলারুশের সমর্থনের কারণে এই নিষেধাজ্ঞাগুলো আরোপ করা হয়েছিল।
বেলারুশের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ভ্যালেরি কারবালেভিচ অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেন, “লুকাশেঙ্কো স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন এবং এত বিপুল সংখ্যক রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংলাপ শুরুর একটি ইঙ্গিত, যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাগুলি কিছুটা শিথিল করা যেতে পারে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “৫ বছর পর লুকাশেঙ্কো ক্রেমলিন তাঁকে ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য ব্যবহার করার যে সম্পর্ক তৈরি করেছে, তা আলগা করার চেষ্টা করছেন।” বেলারুশ রাশিয়াকে ইউক্রেনে সেনা ও অস্ত্র পাঠাতে এবং সেখানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে সহায়তা করেছে।
তবে, এখনও অনেক বিরোধী নেতা বেলারুশের কারাগারে বন্দী জীবন কাটাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অ্যালেস বিয়ালিয়াৎস্কি। তিনি মানবাধিকারের পক্ষে একজন সক্রিয় কর্মী এবং বর্তমানে ১০ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করা হয়।
বিয়ালিয়াৎস্কি, যিনি বেলারুশের প্রাচীনতম ও সবচেয়ে প্রভাবশালী মানবাধিকার সংগঠন ভিয়াসনার প্রতিষ্ঠাতা, ২০২১ সালে দেশটির প্রধান নিরাপত্তা সংস্থার অভিযানে গ্রেপ্তার হন। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে তাঁকে “প্রকাশ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির” অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কর্তৃপক্ষ তাঁকে বিশেষভাবে বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করে।
বিয়ালিয়াৎস্কি, তাঁর পরিবার এবং সমর্থকেরা এই অভিযোগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বেলারুশ সরকারের প্রতি তাঁকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বিয়ালিয়াৎস্কিকে ২০২২ সালে রাশিয়ার মানবাধিকার সংগঠন মেমোরিয়াল এবং ইউক্রেনের সেন্টার ফর সিভিল লিবার্টিজের সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়।
এছাড়াও, কারাগারে বন্দী রয়েছেন ভিক্টর বাবায়কো, যিনি ২০২০ সালে লুকাশেঙ্কোর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন, এবং স্বেতলানা তিখানোভস্কায়ার ঘনিষ্ঠ সহযোগী মারিয়া কোলেসনিকোভা। কোলেসনিকোভা বিক্ষোভের সময় প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠেন। বেলারুশ কর্তৃপক্ষ যখন তাঁকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার চেষ্টা করে, তখন তিনি সীমান্তে তাঁর পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলেন এবং বেলারুশে ফিরে আসেন।
অন্যদিকে, মুক্তি পাওয়াদের মধ্যে রয়েছেন রেডিও ফ্রি ইউরোপ/রেডিও লিবার্টি-র দীর্ঘদিনের সংবাদদাতা ইগর কারনে। তিনি মার্কিন সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত একটি সংবাদ মাধ্যমের হয়ে কাজ করতেন। তিনি “চরমপন্থার” অভিযোগে তিন বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছিলেন, যা তিনি মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস-এর মতে, বেলারুশ বর্তমানে ইউরোপের মধ্যে সাংবাদিকদের বন্দী করার ক্ষেত্রে শীর্ষ স্থানে রয়েছে। বেলারুশের স্বাধীন সাংবাদিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে অন্তত ৪০ জন সাংবাদিক দীর্ঘ কারাদণ্ড ভোগ করছেন। মানবাধিকার কর্মী ও প্রাক্তন বন্দীদের মতে, কারাগারে তাঁদের মারধর করা হয়, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং আইনজীবী বা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয় না।
বেলারুশ সরকার এস্তোনিয়ার নাগরিক অ্যালান রইওকেও মুক্তি দিয়েছে। তিনি বেলারুশ থেকে আসা শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে একটি এনজিও স্থাপন করেছিলেন। এস্তোনিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রইওকে গত জানুয়ারিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং একটি চরমপন্থী সংগঠন প্রতিষ্ঠার অভিযোগে সাড়ে ৬ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস