একটা সময়ে স্পেনের একটি ছোট্ট মৎস্য বন্দর ছিল বেনিডর্ম। কিন্তু আজ, এটি সারা বিশ্ব থেকে আসা পর্যটকদের কাছে একটি জনপ্রিয় গন্তব্য।
প্রতি বছর এখানে ভিড় করেন কয়েক মিলিয়ন মানুষ। এক সময়ের শান্ত সমুদ্র উপকূল কিভাবে এত বড় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হলো, সেই গল্পটাই আজ আমরা জানবো।
ষাটের দশকে, মাদ্রিদের একজন সামান্য চিত্রকর রামোন মার্তিনেজ মার্তিনেজ নতুন সুযোগের সন্ধানে দক্ষিণে বেনিডর্মে পাড়ি জমান। সে সময়ে বেনিডর্ম পরিচিত ছিল তার টুনা মাছ আর কমলালেবুর জন্য।
কিন্তু মার্তিনেজের আগমনের পরেই এখানে পর্যটনের জোয়ার আসতে শুরু করে, যা তার পরিবারকে ভালো জীবন উপহার দেয়। মার্তিনেজ এই পরিবর্তনের সুফল সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন, কিন্তু তিনি নিজেও হয়তো ভাবতে পারেননি যে এই ছোট্ট শহরটি ভবিষ্যতে কেমন রূপ নেবে।
আজ, বেনিডর্ম “ভূমধ্যসাগরের নিউ ইয়র্ক” নামে পরিচিত। আকাশচুম্বী অট্টালিকার ঘনত্বের কারণে এর এই খ্যাতি।
ফল চাষি ও মৎস্যজীবীদের বদলে এখানে এখন সারা স্পেন এবং ইউরোপ থেকে আসা পর্যটকদের আনাগোনা। ২০২৩ সালে প্রায় ২৭ লক্ষ পর্যটক বেনিডর্মে ভ্রমণ করেছেন, যা এখানকার স্থায়ী বাসিন্দাদের থেকে ৩৬ গুণ বেশি!
বেনিডর্ম একই সাথে অর্থনৈতিক সাফল্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এবং স্পেনের পর্যটন শিল্পের লাগামছাড়া গতির প্রতীক।
ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার রব বল তার নতুন বই “বেনিডর্ম”-এ শহরটির এই ভিন্ন রূপ তুলে ধরেছেন।
তিনি জানান, এই অঞ্চলের “অনন্য” দৃশ্য ও স্থাপত্য ক্যামেরাবন্দী করতে তিনি এখানে এসেছিলেন। বেনিডর্মে আসা পর্যটকদের প্রায় এক তৃতীয়াংশই আসেন যুক্তরাজ্য থেকে।
এখানকার ব্রিটিশ পাব, ফুল ইংলিশ ব্রেকফাস্ট এবং খেলাধুলার লাইভ সম্প্রচার এটিকে ব্রিটিশ পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। প্রতি বছর মার্চ মাসে, হাজার হাজার ব্রিটিশ নাগরিক তাদের দেশে অনুষ্ঠিত জনপ্রিয় ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা ‘চেলটেনহ্যাম ফেস্টিভ্যাল’-এর খেলা সরাসরি উপভোগ করতে বেনিডর্মে ভিড় করেন।
যুক্তরাজ্যের অনেকের কাছে বেনিডর্ম “ব্ল্যাকপুল উইথ সান” নামেও পরিচিত। ব্ল্যাকপুলও যুক্তরাজ্যের একটি সমুদ্র শহর, যা অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।
কারো কারো মতে, বেনিডর্ম হল ছুটি কাটানোর আদর্শ জায়গা – গরম আবহাওয়া, পরিচিত মুখ, আর বারগুলো ভোর পর্যন্ত খোলা থাকে।
আবার কারো কাছে এটি একটি অনিয়ন্ত্রিত ও কদর্য পর্যটন গন্তব্য। রব বল অবশ্য এই শহরের ইতিবাচক দিকগুলো – প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সমুদ্রের তীরে পর্যটকদের আনন্দময় মুহূর্তগুলো ক্যামেরাবন্দী করেছেন।
রামোন মার্তিনেজের ছেলে এবং হোটেল বেনিডর্ম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হাইমে মার্তিনেজ গ্যালিনার মতে, বেনিডর্মের এই সাফল্যের পেছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন তৎকালীন মেয়র পেদ্রো সারগোজ়া।
সারগোজ়া শহরটিকে আধুনিক রূপ দিতে চেয়েছিলেন, যা ষাটের দশকে স্পেনের উপকূলের জন্য ছিল একেবারে নতুন।
তিনি ইউরোপজুড়ে বেনিডর্মের উজ্জ্বল রোদ আর সমুদ্রের আকর্ষণ ছড়িয়ে দেন এবং ১৯৫৯ সালে এখানকার সৈকতে বিকিনি পরার অনুমতি দেন। এর ফলস্বরূপ, পর্যটকদের আগমন বাড়তে থাকে।
বেনিডর্মের স্থাপত্যের বিকাশে এক ধরনের “পুরোপুরি উন্মুক্ত” মনোভাব দেখা যায়। পাহাড় এবং সমুদ্রের মাঝে, ক্রমবর্ধমান পর্যটকদের থাকার জায়গা তৈরি করতে কেবল উঁচু ভবন নির্মাণের দিকেই মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল।
একবিংশ শতাব্দীতে এখানে মাদ্রিদের বাইরে স্পেনের দুটি সবচেয়ে উঁচু ভবন তৈরি হয়েছে – গ্রান হোটেল বালি (২০০২ সালে নির্মিত) এবং রেসিডেন্সিয়াল ইনটেম্পো (২০২১ সাল)।
পর্যটন শিল্পের এই দ্রুত বিকাশের ফলে, বেনিডর্মে অতিরিক্ত পর্যটকদের আগমন সেখানকার পরিবেশের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে।
গ্যালিনার মতে, “এখনকার চ্যালেঞ্জ হল কীভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উন্নয়ন করা যায়। জমির প্রায় সবটাই ব্যবহৃত হয়ে গেছে। বেনিডর্ম প্রায় সারা বছরই পরিপূর্ণ থাকে।
আমরা যদি এভাবে বাড়তে থাকি, তবে হয়তো পরিবেশের ক্ষতি হতে শুরু করবে।”
পর্যটকদের কাছে বেনিডর্মের আকর্ষণ এখনো কমেনি। এখানকার সমুদ্র, রোদ আর ব্রিটিশ পর্যটকদের ভিড় – সবকিছু মিলিয়ে বেনিডর্ম হয়তো এমন একটি গন্তব্য হয়েই থাকবে, যা মানুষ ভালোবাসে, অথবা ঘৃণা করে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন