বার্লিনে শরণার্থী-আশ্রয়ে হামলার ঘটনা বৃদ্ধি, বাড়ছে আতঙ্ক!

জার্মানিতে আশ্রয়প্রার্থীদের উপর হামলার ঘটনা বাড়ছে, বাড়ছে চরম-ডানপন্থীদের অপরাধও। সম্প্রতি বার্লিনে আশ্রয়প্রার্থীদের উপর আক্রমণের ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে, জার্মানিতে চরম-ডানপন্থী অপরাধের সংখ্যাও বাড়ছে, যা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বার্লিনের স্থানীয় গ্রিন পার্টির দুই সদস্যের অনুরোধের পর প্রকাশিত সরকারি তথ্যে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে আশ্রয়প্রার্থী ও শরণার্থীদের উপর ৭৭টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও, তাদের থাকার স্থানে ইচ্ছাকৃতভাবে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে আটটি। যেখানে ২০২৩ সালে শরণার্থীদের উপর হামলার ঘটনা ছিল ৩২টি এবং কোনো ভাঙচুরের খবর পাওয়া যায়নি।

আশ্রয়প্রার্থীদের উপর হামলার ফলে ৩৪ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হয়েছেন। এদের মধ্যে ১৬ জন নারী, ১৪ জন পুরুষ এবং দুজন মেয়ে শিশু ও দুইজন বালক ছিল। হামলায় জড়িত সন্দেহে ৩৭ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ১১ জন পুলিশের পরিচিত। শরণার্থীদের আশ্রয়কেন্দ্রে হামলার ঘটনায় এখনো পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।

গ্রিন পার্টির আরেক সদস্য জিয়ান ওমর এই পরিস্থিতিকে “বিপজ্জনক সংকেত” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি শরণার্থীদের জন্য একটি সুস্পষ্ট নিরাপত্তা পরিকল্পনা, ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে পুলিশের উপস্থিতি বাড়ানো, ব্যাপক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ডানপন্থী সহিংসতাকে কঠোরভাবে মোকাবেলা করার দাবি জানিয়েছেন।

বার্লিনে বর্তমানে প্রায় ৩৫,০০০ নিবন্ধিত শরণার্থী সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র ও ডরমিটরিতে বসবাস করছেন। এছাড়া, আরও ১০,০০০ শরণার্থী জরুরি আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি অংশ পুরনো টেগেল ও টেম্পেলহফ বিমানবন্দরে আশ্রয় নিয়েছেন। প্রায়ই তাদের খারাপ জীবনযাপনের অভিযোগ শোনা যায়।

শরণার্থী বিষয়ক রাজ্য কার্যালয় (এলএএফ) স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, সহিংসতা প্রতিরোধের জন্য তাদের সব আশ্রয়কেন্দ্রে পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ স্থানে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা কর্মীও মোতায়েন করা হয়েছে।

অন্যদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়নজুড়ে শরণার্থী আগমনের সংখ্যা হ্রাসের মধ্যে, বার্লিনে নতুন করে আসা শরণার্থীর সংখ্যাও কমেছে। এলএএফ-এর তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে নতুন আসা শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ১,৭৬১ জন, যা ২০২৪ সালের একই সময়ের তুলনায় ৩৫ শতাংশের বেশি কম। বার্লিনে আসা শরণার্থীদের মধ্যে বেশিরভাগ এসেছেন ভিয়েতনাম, মলদোভা, আফগানিস্তান, তুরস্ক ও সিরিয়া থেকে।

এছাড়াও, ইউক্রেনীয় নাগরিকরা, যারা জার্মানিতে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত, তারাও আগের তুলনায় কম সংখ্যায় এসেছেন। ২০২৫ সালের প্রথম দুই মাসে ১,৭২২ জন ইউক্রেনীয় বার্লিনে এসেছেন। যেখানে ২০২৪ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ২,৬১১ জন ইউক্রেনীয় নাগরিক রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে বাঁচতে বার্লিনে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

ফেব্রুয়ারিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শরণার্থীদের আশ্রয়কেন্দ্রে “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” হামলার ঘটনাও বেড়েছে। ২০২৩ সালে যেখানে এমন ঘটনা ছিল ১৬৭টি, সেখানে ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১৮টিতে। তবে, শরণার্থীদের উপর ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণের ঘটনা ২০২৩ সালের তুলনায় কমেছে।

বামপন্থী দল ‘লিংকে’র সংসদ সদস্য ক্লারা বুঙ্গার বলেছেন, সরকার দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। তিনি বলেন, শরণার্থীদের বিরুদ্ধে অপমান, হুমকি ও হামলার সংখ্যা দীর্ঘদিন ধরে উদ্বেগজনকভাবে বেশি এবং অনেক রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ধরনের ঘটনাকে হালকাভাবে নেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়, যা হতাশাজনক। তিনি এই পরিস্থিতির জন্য চরম-ডানপন্থী এবং মূলধারার দলগুলোর অভিবাসনবিরোধী বক্তব্যকে দায়ী করেছেন।

মার্চ মাসে বার্লিনের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত স্টাহনসডর্ফ শহরে সাতজন চরম-ডানপন্থী কর্মী একটি শরণার্থী আশ্রয়ে জোর করে প্রবেশের চেষ্টা করে। নিরাপত্তা কর্মীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয় এবং এতে এক নিরাপত্তা কর্মী আহত হন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, হামলার আগে তারা ভবনের বাইরে একটি দলকে চরম-ডানপন্থী স্লোগান দিতে শুনেছিলেন।

জার্মান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত বছর চরম-ডানপন্থী অপরাধের ঘটনা ১৭ শতাংশের বেশি বেড়েছে। নভেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত ৩৩,৯৬৩টি অপরাধের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে, যার মধ্যে ১,১৩৬টি ছিল সহিংস হামলা। আগামী মাসে এই সংক্রান্ত বার্ষিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হবে।

ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে কট্টর-ডানপন্থী ‘জার্মানির জন্য বিকল্প’ (এএফডি) পার্টি উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে ২০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে। বর্তমানে তারা সংসদে প্রধান বিরোধী দল। অভিবাসন নিয়ে ভোটারদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের কারণে দলটির এই সাফল্য এসেছে।

অন্যদিকে, রক্ষণশীল নেতা ফ্রিডরিশ মের্জ ৬ মে চ্যান্সেলর হিসেবে শপথ নিতে যাচ্ছেন। তিনি সীমান্ত নীতি কঠোর করা এবং অনিয়মিত অভিবাসন বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যদিও মধ্য-বামপন্থী সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে জোট গঠনের ফলে মের্জের অনেক লক্ষ্যই দুর্বল হয়ে গেছে, তবে শরণার্থীদের পারিবারিক পুনর্মিলন স্থগিত করা, সীমান্ত অঞ্চলে আশ্রয়প্রার্থীদের প্রবেশ বন্ধ করতে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করা এবং সিরিয়া ও আফগানিস্তানের মতো দেশগুলোতে বিতাড়নের পরিকল্পনা করা সহ বেশ কিছু কঠোর প্রস্তাবনা এখনো রয়েছে।

তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *