নুন: জীবন ধারণের অপরিহার্য উপাদান, নাকি নীরব ঘাতক?
উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং কিডনির সমস্যা—এসব রোগের সঙ্গে নুনের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। অতিরিক্ত লবণ খাওয়ার ফলে শরীরে দেখা দিতে পারে মারাত্মক সব স্বাস্থ্য জটিলতা।
কিন্তু একজন সুস্থ মানুষের জন্য দৈনিক কতটুকু লবণ গ্রহণ করা নিরাপদ? স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এই বিষয়ে রয়েছে বিস্তর মতভেদ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) মতে, একজন সুস্থ মানুষের দৈনিক ২ গ্রামের বেশি সোডিয়াম গ্রহণ করা উচিত নয়। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন (AHA) দৈনিক ২.৩ গ্রামের বেশি সোডিয়াম গ্রহণের সীমা নির্ধারণ করেছে, যা প্রায় এক চা চামচ লবণের সমান।
তাদের মতে, এই পরিমাণ লবণ গ্রহণ করলে রক্তচাপ খুব একটা বাড়ে না। এমনকি, যাদের উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এই গ্রহণের পরিমাণ আরও কমানো উচিত।
কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অজান্তেই অনেক বেশি লবণ গ্রহণ করা হয়ে যায়। একটি সাধারণ বার্গার, এক বাটি স্যুপ অথবা দু’টুকরো পিৎজা—এসব খাবার সহজেই দৈনিক লবণের চাহিদা পূরণ করে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের গড় দৈনিক সোডিয়াম গ্রহণের পরিমাণ ৩.৪ গ্রাম। বিশ্বজুড়ে এই পরিমাণ ৪.৩ গ্রাম, যার পেছনে রয়েছে পূর্ব ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো, যেখানে নোনতা খাবারের বেশ কদর রয়েছে।
উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের সম্পর্ক নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। তবে মূল বিতর্কটা হলো, ঠিক কতটুকু লবণ গ্রহণ করলে তা ঝুঁকির কারণ হবে।
লবণ আমাদের শরীরে কী করে?
টেবিল সল্ট বা সাধারণ লবণে সোডিয়াম এবং ক্লোরাইড নামক দুটি উপাদান থাকে। সোডিয়াম এই দুটির মধ্যে বেশি উদ্বেগের কারণ।
শরীরে সোডিয়ামের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে এটি জলীয় উপাদান ধরে রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু অতিরিক্ত সোডিয়াম গ্রহণের ফলে শরীরে জলীয় অংশের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা রক্তচাপ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
সোডিয়ামের পরিমাণ বেড়ে গেলে শরীর অতিরিক্ত জল ধরে রাখে, ফলে রক্তের আয়তন বাড়ে। হৃদযন্ত্রকে তখন এই অতিরিক্ত রক্ত পাম্প করার জন্য বেশি কাজ করতে হয়।
এর ফলে রক্তনালীগুলো শক্ত হয়ে যায় এবং দেয়ালের ওপর চাপ বাড়ে। অতিরিক্ত লবণ শরীর থেকে বের করার জন্য কিডনিকেও বেশি কাজ করতে হয়।
দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ করলে হৃদযন্ত্র এবং কিডনির ওপর মারাত্মক চাপ পড়ে। একসময় এগুলো দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
এর ফলস্বরূপ, কিডনি বিকল হওয়া, হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের মতো গুরুতর সমস্যা দেখা দিতে পারে।
এছাড়াও, অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের ফলে পাকস্থলীতে আলসার এবং ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়ে। কিছু গবেষণায় দাবি করা হয়েছে যে লবণ হাড় থেকে ক্যালসিয়াম শুষে নেয়, যার ফলে অস্টিওপোরোসিস হতে পারে। যদিও সবার ক্ষেত্রে এই প্রভাব দেখা যায় না।
লবণ নিয়ে বিতর্ক
নোনতা খাবারের প্রতি আমাদের শরীরের একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ থাকে। তাই লবণ গ্রহণ সীমিত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
লবণ শরীরের জন্য প্রয়োজনীয়। শরীরে লবণের অভাব হলে মাংসপেশিতে খিঁচুনি হতে পারে, সেই সঙ্গে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স এবং এথেরোস্ক্লেরোসিসের মতো গুরুতর সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের মতো, কম লবণ গ্রহণও শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তবে কম লবণ গ্রহণের ঘটনা তুলনামূলকভাবে বিরল।
কিছু গবেষক মনে করেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় লবণ গ্রহণের বিষয়ে বর্তমানের সতর্কবার্তাগুলো অতিরিক্ত কঠোর। ন্যাশনাল একাডেমি অফ মেডিসিনের একটি গবেষণা অনুযায়ী, দৈনিক ২.৩ গ্রামের সীমা নির্ধারণের পক্ষে পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই।
এই বিষয়টি চিকিৎসা মহলে ‘লবণ যুদ্ধ’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
তবে সুইজারল্যান্ডের বার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফ্রাঞ্জ মেসারলি মনে করেন, লবণের সঙ্গে রক্তচাপের সম্পর্ক অন্যান্য বিষয় দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে।
একজন ব্যক্তির স্বাস্থ্যগত ইতিহাস, মানসিক চাপ, পেশা (যেমন: যারা বেশি গরম পরিবেশে কাজ করেন), এবং জীবনযাত্রার ধরনের ওপর এটি নির্ভর করে।
যারা নিয়মিত ব্যায়াম করেন, তাদের ক্ষেত্রেও বেশি লবণ গ্রহণ করার সুযোগ থাকে, কারণ ব্যায়াম রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।
গবেষকরা মনে করেন, লবণ গ্রহণের সঙ্গে হৃদরোগের সম্পর্ক একটি ‘জে-শেপড কার্ভ’-এর মতো। অর্থাৎ, খুব কম বা খুব বেশি—উভয় অবস্থাই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
চিকিৎসা বিষয়ক নির্দেশিকা অনুযায়ী, একজন মানুষের দৈনিক সর্বনিম্ন ০.৫ গ্রাম সোডিয়াম গ্রহণ করা প্রয়োজন।
একজন ব্যক্তির শরীরে লবণের প্রভাব ভিন্ন হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় আফ্রিকান-আমেরিকানদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা প্রায় দ্বিগুণ।
এর কারণ হিসেবে তাদের জিনগত এবং আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলো দায়ী হতে পারে।
মেসারলির মতে, “লবণ যে ক্ষতির কারণ হয়, তা কতটা এবং কখন হয়—সে বিষয়ে এখনো বিস্তারিত জানা যায়নি।”
লবণ নিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটাতে হলে একটি নির্ভরযোগ্য পরীক্ষার প্রয়োজন, যেখানে অনেক মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করতে হবে।
তবে এমন একটি গবেষণা চালানো বেশ কঠিন। কারণ, অনেক মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে কম সোডিয়ামযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে পারে না।
২০১৯ সালে একদল গবেষক প্রস্তাব করেছিলেন, কয়েদিদের ওপর এই ধরনের পরীক্ষা চালানো যেতে পারে, যেখানে তাদের খাবার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
কিন্তু এতে নৈতিক কিছু বিষয় জড়িত রয়েছে।
নতুন গবেষণা থেকে জানা যায়, লবণ শুধু রক্তচাপের ওপর প্রভাব ফেলে না, এটি শরীরের আরও অনেক কাজে সহায়তা করে।
ম্যাক্স ডেলব্রুক সেন্টার ফর কার্ডিওভাসকুলার রিসার্চের বিজ্ঞানী ডমিনিক মুলারের মতে, লবণ কোষের বিপাক ক্রিয়াকে প্রভাবিত করে এবং রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুদের বিরুদ্ধে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
তার দল আরও দেখেছে, শরীরের ক্ষত সারাতে লবণ সাহায্য করে।
তবে অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে, যা হৃদরোগ এবং অটোইমিউন রোগের কারণ হতে পারে।
ডমিনিক মুলার বলেন, “লবণের সংবেদনশীলতার সংজ্ঞা মূলত রক্তচাপের ওপর নির্ভরশীল। সম্ভবত, লবণের সংবেদনশীলতাকে আরও বৃহত্তর অর্থে বিবেচনা করা উচিত—রক্তচাপের পাশাপাশি কোষের কার্যকারিতার সঙ্গেও এর সম্পর্ক রয়েছে।”
লবণ গ্রহণ কমানোর উপায়
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত লবণের সামান্য অংশ রান্নার সময় যোগ করা হয়। বাকি ৭০ শতাংশের বেশি লবণ আসে প্রক্রিয়াজাত খাবার থেকে।
লবণ খাদ্য সংরক্ষণে সাহায্য করে, খাবারের গঠন পরিবর্তন করে এবং মাংস জাতীয় খাবারে জলীয় ভাব ধরে রাখে। এমনকি রুটির মতো খাবারেও প্রচুর পরিমাণে সোডিয়াম থাকে।
বাজারে উপলব্ধ খাবারে লবণের আধিক্য এবং উচ্চ রক্তচাপের ক্রমবর্ধমান সমস্যা—এগুলো বিবেচনা করে লবণ গ্রহণ কমানো অত্যন্ত জরুরি।
নেফ্রোলজিস্ট এবং স্পোর্টস নেফ্রোলজি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাতা রায়েদা ঘিয়াওয়ালা বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে দৈনিক ২.৩ গ্রাম সোডিয়াম গ্রহণের যে সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা খুব বেশি কঠোর নয়।”
ঘরে রান্না করা খাবার খাওয়ার মাধ্যমে লবণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা সবচেয়ে সহজ।
রায়েদা তার রোগীদের সপ্তাহে তাদের খাবারের পরিকল্পনা করার পরামর্শ দেন, যাতে তারা বাইরের নোনতা খাবার এড়িয়ে চলতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, “সাধারণত, খাবারের মাঝে খাওয়া স্ন্যাকস-ই মানুষের শরীরে অতিরিক্ত লবণ যোগ করে।”
চিপস, চানাচুর বা অন্যান্য নোনতা স্ন্যাকসের পরিবর্তে ফল, সবজি এবং লবণ ছাড়া বাদাম খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
লবণের বিকল্প হিসেবে পটাশিয়াম সমৃদ্ধ লবণ ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি সোডিয়ামের বিকল্প হিসেবে স্বাদ যোগ করে।
যদিও অতিরিক্ত পটাশিয়ামও শরীরের জন্য ক্ষতিকর, তবে অধিকাংশ মানুষ পর্যাপ্ত পটাশিয়াম গ্রহণ করে না বলে এটি ঝুঁকির কারণ হয় না।
চীনের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, দৈনিক লবণের এক-চতুর্থাংশ পটাশিয়াম সমৃদ্ধ লবণ দিয়ে প্রতিস্থাপন করলে স্ট্রোকের ঝুঁকি ১২ শতাংশ এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি ১৩ শতাংশ কমে যায়।
রায়েদা, মুলার এবং মেসারলি—এই তিনজনই লবণ গ্রহণের বিষয়ে সচেতন থাকেন, তবে তারা অতিরিক্ত কড়াকড়ি করেন না।
তাদের মতে, মাঝে মাঝে চিপস, সালামি বা ক্র্যাকার খেলে খুব বেশি ক্ষতি নেই, যা ব্যায়ামের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক