গর্ভনিরোধক পিলের মাধ্যমে পিরিয়ড বন্ধ করা: স্বাস্থ্য ঝুঁকি?

একটি মাসিক ঋতুস্রাব কি সবসময় প্রয়োজনীয়? জন্মনিয়ন্ত্রণ পিলের মাধ্যমে মাসিকের বিরতি নিয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত

মাসিক ঋতুস্রাব নারীদের একটি স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া। কিন্তু অনেক নারীর কাছেই এই সময়ে নানান শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়, যেমন – পেট ব্যথা, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, দুর্বলতা, এবং আরও অনেক উপসর্গ।

হরমোনাল জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, যা সাধারণত গর্ভধারণ প্রতিরোধের জন্য ব্যবহৃত হয়, মাসিক বন্ধ করার একটি উপায় হতে পারে। সম্প্রতি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই বিষয়ে ভুল তথ্য ও কুসংস্কার বেড়ে যাওয়ায়, বিষয়টি নিয়ে সঠিক ধারণা দেওয়া জরুরি।

ডাঃ কবিতা নন্দা, যিনি একজন প্রখ্যাত প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ এবং ফ্লোরিডার FHI 360 নামক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ক্লিনিক্যাল গবেষক, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন।

তিনি বলছেন, “হরমোনাল জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করে মাসিক চক্র এড়িয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ নিরাপদ হতে পারে।

ডাঃ নন্দার মতে, জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল মূলত দুটি হরমোন – এস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন – এর সমন্বয়ে গঠিত। এই পিল ডিম্বাণু তৈরি হওয়া বন্ধ করে এবং জরায়ুর ভিতরের স্তরকে পাতলা করে দেয়।

এর ফলে, ডিম্বাণু নিষিক্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায় এবং মাসিক হওয়ার প্রক্রিয়াও বাধা পায়। কিছু জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিতে শুধু প্রোজেস্টেরন ব্যবহার করা হয়।

এই পদ্ধতিগুলো হলো – ইনজেকশন, ইমপ্ল্যান্ট, এবং কিছু প্রকারের আইইউডি (IUD)।

নিয়মিত জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল সেবনের একটি সাধারণ নিয়ম হলো, ২১ দিন ওষুধ খাওয়ার পর ৭ দিনের বিরতি দেওয়া। এই সময়ে মাসিক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

কিন্তু অনেক নারীই চান, এই বিরতি ছাড়াই একটানা ওষুধ চালিয়ে যেতে। ডাঃ নন্দা ব্যাখ্যা করেন, “যদি কোনো স্বাস্থ্যগত সমস্যা না থাকে, তবে একটানা ওষুধ সেবনে কোনো সমস্যা নেই।

গবেষণা বলছে, মাসিক বন্ধ করে হরমোনাল পিল চালিয়ে যাওয়া এবং নিয়মিত বিরতি দিয়ে খাওয়ার মধ্যে কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তার দিক থেকে তেমন কোনো পার্থক্য নেই।

ঐতিহাসিকভাবে, জন্মনিয়ন্ত্রণের ধারণা আসার আগে, নারীরা হয়তো নিয়মিত মাসিকের সম্মুখীন হতেন না, কারণ তারা হয়তো গর্ভবতী থাকতেন অথবা শিশুকে বুকের দুধ পান করাতেন। এই সময়ে মাসিক সাধারণত বন্ধ থাকে।

তবে, যদি কোনো নারী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার না করেও মাসিকের সমস্যা অনুভব করেন, তবে অবশ্যই একজন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ, এটি অন্য কোনো স্বাস্থ্য সমস্যার লক্ষণ হতে পারে।

ডাঃ নন্দা আরও বলেন, “মাসিক বন্ধ করার কারণে শরীরে অন্য কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় কিনা, এমন প্রশ্ন অনেকের মনে আসতে পারে।

তবে, নিয়মিত পিল খাওয়ার মতোই কিছু সাধারণ সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন – বমি বমি ভাব, স্তনে ব্যথা অথবা মাথাব্যথা। প্রথম দিকে কিছু ক্ষেত্রে অপ্রত্যাশিত রক্তপাত হতে পারে, তবে সাধারণত এটি সময়ের সাথে কমে যায়।

জন্মনিয়ন্ত্রণ বন্ধ করার পর মহিলাদের স্বাভাবিক প্রজনন ক্ষমতা ফিরে আসে কিনা, সেই বিষয়ে জানতে চাইলে ডাঃ নন্দা বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে হরমোনাল জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করলে বন্ধ্যাত্বের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।

সাধারণত, ওষুধ বন্ধ করার এক থেকে দুই মাসের মধ্যেই মাসিক এবং স্বাভাবিক প্রজনন ক্ষমতা ফিরে আসে।

তাহলে, কেন জন্মনিয়ন্ত্রণ পিলের সাথে ৭ দিনের বিরতি যুক্ত করা হয়? ডাঃ নন্দা এর কারণ ব্যাখ্যা করেন।

১৯৫০-এর দশকে যখন জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল তৈরি হয়, তখন এই বিরতির মূল কারণ ছিল সাংস্কৃতিক ও সামাজিক। সেই সময়, ২৮ দিন পর পর মাসিক হওয়াকে স্বাভাবিক নারী স্বাস্থ্যের লক্ষণ হিসেবে দেখা হতো।

সেই ধারণার সাথে সঙ্গতি রেখে, পিলের এই নিয়ম তৈরি করা হয়, যা ব্যবহারকারী এবং চিকিৎসকদের আশ্বস্ত করত যে তারা গর্ভবতী নন। এছাড়া, এটি জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে সমাজের দ্বিধা কাটাতেও সাহায্য করেছে।

ডাঃ নন্দা আরও যোগ করেন, “যাদের মাসিকের সময় অতিরিক্ত ব্যথা হয়, বেশি রক্তক্ষরণ হয়, এন্ডোমেট্রিওসিস বা মাইগ্রেনের সমস্যা আছে, অথবা যাদের শরীরে আয়রনের অভাব রয়েছে, তাদের জন্য একটানা পিল সেবন বিশেষভাবে সহায়ক হতে পারে।

এছাড়াও, শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতা সম্পন্ন নারী এবং ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের জন্যও এটি একটি ভালো বিকল্প হতে পারে।

যদি আপনি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে কোনো দ্বিধায় ভোগেন, তবে আপনার স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শদাতার সাথে কথা বলুন।

বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা ক্লিনিক ও সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে এ বিষয়ে সহায়তা পাওয়া যায়। সঠিক তথ্যের মাধ্যমে, আপনি আপনার জন্য উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *