উড়োজাহাজ ছাড়াই বিশ্ব ভ্রমণ! এক ব্যক্তির অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা

বিশ্বের প্রতিটি দেশ – উড়োজাহাজ ছাড়া! এমন দুঃসাহসিক ভ্রমণ করেছেন ডেনমার্কের নাগরিক থোর পেডারসেন। দীর্ঘ ১০ বছর ধরে চলা এই ভ্রমণে তিনি অনেক কিছু শিখেছেন, যা আমাদের জীবনকে নতুনভাবে দেখতে সাহায্য করে। আসুন, সেই অদম্য অভিযাত্রীর বিশ্ব ভ্রমণের কিছু শিক্ষণীয় দিক সম্পর্কে জানা যাক।

২০১৩ সালে থোর তার যাত্রা শুরু করেন। আধুনিক যুগে যখন আকাশপথে কয়েক ঘন্টায় এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া যায়, তখন তিনি বেছে নিয়েছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ। উড়োজাহাজকে এড়িয়ে তিনি হেঁটে, বাসে, ট্রেনে এবং জাহাজে চড়ে পৃথিবীর প্রতিটি দেশ ঘুরেছেন। এই দীর্ঘ এবং কষ্টসাধ্য ভ্রমণে তিনি মানুষের জীবন, প্রকৃতি এবং সম্পর্কের গভীরতা উপলব্ধি করেছেন।

প্রথমেই বলতে হয় মানুষের উদারতার কথা। পোল্যান্ডের একটি প্রত্যন্ত শহরে শীতের রাতে তিনি যখন সাহায্যের জন্য দিশেহারা হয়ে পড়েন, তখন এক অচেনা নারী তাকে আশ্রয় দেন। খাবার খাওয়ানো থেকে শুরু করে থাকার ব্যবস্থা করা—সবকিছুই ছিল সেই নারীর আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ। এমন ঘটনা শুধু পোল্যান্ডে নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঘটেছে, যা মানুষের প্রতি বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করে।

লেসোথোর পার্বত্য অঞ্চলে প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য তাকে মুগ্ধ করেছে। সবুজ পাহাড়, পাখির কলকাকলি, স্বচ্ছ বাতাস আর নীল আকাশের নিচে মালতসুনায়ানে জলপ্রপাত—যেন এক অন্য জগৎ। প্রকৃতির এই সৌন্দর্য শুধু লেসোথোর নয়, বিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে।

পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে ইবোলা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময়ও তিনি সেখানকার মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা দেখেছেন। দারিদ্র্য আর মহামারীর মধ্যেও তারা হাসি-আনন্দ ভুলে যায়নি। একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে তিনি সেখানকার মানুষের প্রাণবন্ততা প্রত্যক্ষ করেছেন, যেখানে সবাই একসঙ্গে আনন্দ করেছে।

ভ্রমণের সময় থোর ভাষার সীমাবদ্ধতা অনুভব করেছেন, তবে মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে তা বাধা হয়নি। বেলারুশ থেকে মস্কো যাওয়ার পথে, তিনি এমন এক ট্রেনের যাত্রী ছিলেন, যেখানে সবাই রাশিয়ান ভাষায় কথা বলতেন। ভাষা না বুঝলেও, তারা তার সঙ্গে খাবার ভাগাভাগি করেছেন, গল্প করেছেন। হাসি-ঠাট্টার মাধ্যমে তৈরি হয়েছে এক দারুণ সম্পর্ক।

আমাদের সমাজে অনেক সময় আমরা অন্যদের থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করি। কিন্তু থোর উপলব্ধি করেছেন, সবার সঙ্গে মিশে যাওয়ার মধ্যে রয়েছে অন্যরকম আনন্দ। বাসের মধ্যে, পথের পাশে, অচেনা মানুষের সঙ্গে গল্প করার সুযোগ তৈরি হয়, যা আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতাকে আরও সমৃদ্ধ করে।

থোর দীর্ঘ এই ভ্রমণে অনেক কিছু চেয়েছেন, আবার অনেক কিছুই তার প্রয়োজন ছিল। তিনি দেখেছেন, ভ্রমণের শুরুতে যা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, দীর্ঘ সময় পর তার গুরুত্ব কমে গেছে। সম্পর্কের গভীরতা এবং মানুষের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলোই তার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান ছিল।

ধীরে ধীরে ভ্রমণ করার কারণে পৃথিবীর বিশালতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। দ্রুত উড়োজাহাজে এক দেশ থেকে অন্য দেশে গেলে অনেক কিছুই হয়তো চোখ এড়িয়ে যায়। কিন্তু ধীরে চললে, প্রকৃতির পরিবর্তন, মানুষের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতির ভিন্নতা—সবকিছু অনুভব করা যায়।

ভ্রমণের সময় নতুন কিছু শেখার সুযোগ হয়। নতুন ভাষা শেখা, ভিন্ন সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা এবং বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে মিশে জীবন সম্পর্কে অনেক নতুন ধারণা তৈরি হয়। থোর পেডারসেনের এই ভ্রমণ আমাদের দেখায়, জীবনকে নতুনভাবে অনুভব করতে হলে, ঝুঁকি নিতে হয়, চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হয়।

থোর পেডারসেনের এই অসাধারণ যাত্রা আমাদের সবার জন্য একটি উদাহরণ। প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়, মানুষ হিসেবে আমরা কতটা উদার হতে পারি, প্রকৃতির সৌন্দর্যকে কীভাবে উপভোগ করা যায়—এইসব বিষয়গুলো তিনি তার অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমাদের শিখিয়েছেন।

তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *