যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সিনেটর বব মেনেনদেজের স্ত্রী নাদিন মেনেনদেজ ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। নিউইয়র্কের একটি ফেডারেল আদালতে সোমবার এই রায় ঘোষণা করা হয়।
নাদিন তাঁর স্বামীর সঙ্গে মিলে ব্যবসায়িক সুবিধা ও আইনি জটিলতা থেকে মুক্তি পেতে তিনজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নগদ অর্থ, সোনার বার এবং একটি বিলাসবহুল গাড়ি ঘুষ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। খবরটি জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)।
বিচারকরা নাদিন মেনেনদেজের বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পান। এর আগে, একই আদালতে বব মেনেনদেজকে অনুরূপ অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল।
জানা গেছে, আগামী জুন মাস থেকে বব মেনেনদেজের ১১ বছরের কারাদণ্ড ভোগ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। নাদিন মেনেনদেজের সাজা ঘোষণার তারিখ নির্ধারিত হয়েছে ১২ই জুন।
আদালতের বাইরে নাদিন মেনেনদেজকে গোলাপী রঙের মাস্ক পরে দেখা যায়। তাঁর আইনজীবী ব্যারি কোবার্ন এই রায়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, “আমরা কঠিন লড়াই করেছি এবং এতে আমরা মর্মাহত। আমাদের জন্য এটা খুবই দুঃখের দিন।”
আদালতে শুনানিতে আইনজীবীরা নাদিন মেনেনদেজের সঙ্গে বব মেনেনদেজের প্রেমের সম্পর্কের বিষয়টি তুলে ধরেন। তাঁদের সম্পর্কের শুরুটা হয় ২০১৮ সালের দিকে।
এরপর ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। প্রসিকিউটররা বারবার তাঁদের ‘অপরাধের সহযোগী’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২২ সালে তাঁদের নিউ জার্সির এঙ্গেলউড ক্লিফসের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে এফবিআই কর্মকর্তারা প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার ডলার মূল্যের সোনার বার এবং নগদ ৪ লাখ ৮০ হাজার ডলার উদ্ধার করে।
এছাড়া, গ্যারেজ থেকে একটি মার্সিডিজ-বেঞ্জ কনভার্টেবল গাড়িও জব্দ করা হয়, যা ঘুষ হিসেবে দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ।
নাদিন ও বব মেনেনদেজ উভয়েই তাঁদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
শুরুতে নাদিন মেনেনদেজ এবং বব মেনেনদেজ-এর সঙ্গে অভিযুক্ত তিন ব্যবসায়ীর বিচার একসঙ্গে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নাদিন মেনেনদেজ স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ায় তাঁর অস্ত্রোপচার হয়।
ফলে এক বছর পর তাঁর বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
সাবেক সিনেটর বব মেনেনদেজ গত বছর আগস্টে সিনেট থেকে পদত্যাগ করেন। অভিযোগ দায়েরের আগে তিনি প্রভাবশালী সিনেট পররাষ্ট্র সম্পর্ক কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন।
অভিযোগ অনুযায়ী, নাদিন মেনেনদেজ তাঁদের সম্পর্কের শুরুর দিকে সিনেটরের জন্য ঘুষের ব্যবস্থা করা শুরু করেন।
জানা যায়, এক সময় নাদিন নিউ জার্সির এঙ্গেলউড ক্লিফসে তাঁর বাড়ি হারানোর ঝুঁকিতে ছিলেন। কারণ, তিনি প্রায় ২০ হাজার ডলারের বন্ধকী কিস্তি পরিশোধ করতে পারেননি।
সেই সময় তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু ওয়ায়েল হানা তাঁর বাড়িটি টিকিয়ে রাখতে নগদ অর্থ সরবরাহ করেন। এর বিনিময়ে, সিনেটর হানার একটি ব্যবসায়িক একচেটিয়া অধিকার টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেন, যা তিনি মিশরের সঙ্গে করেছিলেন।
আরেকটি ঘটনায়, নাদিন মেনেনদেজের পুরোনো গাড়ি দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে তিনি নতুন একটি গাড়ি চান। প্রসিকিউটরদের দাবি, ব্যবসায়ী জোসে উরিবে তাঁকে একটি মার্সিডিজ-বেঞ্জ উপহার দেন।
এর প্রতিদানে বব মেনেনদেজ, নিউ জার্সির অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়কে উরিবের সহযোগীদের বিরুদ্ধে তদন্ত বন্ধ করার জন্য চাপ দেন।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ফ্রেড ডাইবসও তাঁদের নগদ অর্থ ও সোনার বার ঘুষ হিসেবে দিয়েছিলেন।
প্রসিকিউটরদের মতে, ডাইবস চেয়েছিলেন সিনেটর যেন নিউ জার্সিতে তাঁর বিরুদ্ধে চলমান একটি ফৌজদারি মামলা থেকে তাঁকে রক্ষা করেন।
বব মেনেনদেজ কাতারভিত্তিক একটি বিনিয়োগ তহবিল থেকে ডাইবসকে ৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিনিয়োগ পেতেও সাহায্য করেছিলেন।
নাদিন মেনেনদেজকে এই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রসিকিউটরদের মতে, নাদিন মেনেনদেজ ব্যবসায়ীদের এবং মিশরীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
ঘুষ নেওয়ার পাশাপাশি বব মেনেনদেজকে মিশর সরকারের এজেন্ট হিসেবে কাজ করারও অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রসিকিউটরদের ভাষ্যমতে, ঘুষের বিনিময়ে তিনি মিশরীয় কর্মকর্তাদের হয়ে একটি চিঠি লিখেছিলেন, যা তাঁর সহকর্মীদের কাছে পাঠানো হয়।
ওই চিঠিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে তাঁদের উদ্বেগ কমাতে এবং সামরিক সহায়তার ওপর থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়েছিল।
নাদিন মেনেনদেজের আইনজীবী ব্যারি কোবার্ন যুক্তি দিয়ে বলেন, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই। তিনি আরও বলেন, সিনেটরের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, যা একজন রাজনীতিবিদের তাঁর ভোটারদের জন্য করা উচিত।
এই বিষয়ে মার্কিন সহকারী অ্যাটর্নি ড্যানিয়েল রিচেনথাল বিচারকদের নাদিন মেনেনদেজকে দোষী সাব্যস্ত করার আহ্বান জানান। তিনি প্রমাণগুলোকে ‘সুসংহত এবং অপ্রতিরোধ্য’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
জোসে উরিবে দোষ স্বীকার করে অন্যদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন। ওয়ায়েল হানা ও ফ্রেড ডাইবস-কে সিনেটরের সঙ্গে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
জানা গেছে, হানাকে আট বছরের এবং ডাইবসকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
মার্কিন ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি ম্যাথিউ পোডলস্কি এক বিবৃতিতে বলেন, “এই রায় একটি স্পষ্ট বার্তা দেয় যে সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বিক্রি করা যায় না এবং যারা দুর্নীতিতে সহায়তা করে, তাদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।”
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস