**নাইজেরিয়ায় আবারও সক্রিয় বোকো হারাম: সামরিক বাহিনীর প্রতিরোধে সংকট**
উত্তর-পূর্ব নাইজেরিয়ায় জঙ্গিগোষ্ঠী বোকো হারামের হামলা বেড়ে যাওয়ায় দেশটির নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
ইসলামিক চরমপন্থীরা ঘন ঘন সামরিক ঘাঁটিগুলোতে আক্রমণ করছে, রাস্তার পাশে পেতে রাখছে বোমা, এবং বেসামরিক গ্রামগুলোতেও চালাচ্ছে হামলা।
বছরের শুরু থেকে এই ধরনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই ধারণা করছেন, এক সময়কার ভয়ঙ্কর বোকো হারাম পরিস্থিতি আবার ফিরে আসতে পারে।
যদিও নাইজেরিয়ার সামরিক বাহিনী তাদের সাফল্যের দাবি করে আসছে।
২০০৯ সালে বোকো হারাম পশ্চিমা শিক্ষা ব্যবস্থার বিরোধিতা এবং নিজেদের চরমপন্থী ইসলামিক আইন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়।
এই সশস্ত্র সংঘাত আফ্রিকার ইতিহাসে দীর্ঘতম জঙ্গিবাদের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, এই সংঘাতে প্রায় ৩৫ হাজার বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে এবং ২০ লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বোকো হারামের হামলায় সামরিক বাহিনীর দুর্বলতা আবারও স্পষ্ট হয়েছে।
গত সপ্তাহে বর্নো রাজ্যের গাজিবো গ্রামে স্থানীয় মিলিশিয়া বাহিনীর নয় সদস্য নিহত হয়।
জানা গেছে, জঙ্গিদের অগ্রযাত্রার মুখে সেনারা ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়ে যায়।
এছাড়াও, গত কয়েক মাসে রাস্তার পাশে বোমা বিস্ফোরণ এবং গ্রামগুলোতে হামলার ঘটনা ঘটেছে।
**দুই ভাগে বিভক্ত বোকো হারাম**
বর্তমানে বোকো হারাম দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে।
এর মধ্যে একটি অংশ ইসলামিক স্টেট (আইএস) গোষ্ঠীর সমর্থনপুষ্ট।
এই অংশটি ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রদেশ (আইএসডব্লিউএপি) নামে পরিচিত।
তারা মূলত সামরিক অবস্থানে হামলা চালায়।
বিভিন্ন সূত্রে খবর পাওয়া যায়, চলতি বছর অন্তত ১৫ বার তারা সামরিক বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়েছে, যার ফলে সেনা সদস্য নিহত হয়েছে এবং অস্ত্রশস্ত্র লুট করা হয়েছে।
অন্যদিকে, জামা’আতু আহলিস সুন্নাহ লিদ দাওয়াতু ওয়াল জিহাদ (জেএএস) নামের আরেকটি অংশ বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা এবং তাদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের মতো কাজে জড়িত হচ্ছে।
মে মাসে আইএসডব্লিউএপি গাজিবো, বুনি গারি, মার্তে, ইজগে, রান এবং নাইজেরিয়া-ক্যামেরুনের যৌথ সামরিক ঘাঁটিতেও হামলা চালায়।
এছাড়া, মালম ফাতোরি, গোনিরি, সাবন গারি, ওয়াজিরোকো এবং মঙ্গুনোসহ বিভিন্ন স্থানে তারা আক্রমণ চালিয়েছে।
প্রায়শই তারা রাতের অন্ধকারে হামলা চালায়।
**বিস্তার ও বিকেন্দ্রীকরণ**
পর্যবেক্ষকদের মতে, আইএসডব্লিউএপি-র সাফল্যের মূল কারণ হলো তাদের আঞ্চলিক বিস্তার এবং জেএএস-এর বিরুদ্ধে জয়লাভ।
এছাড়া, তাদের বিকেন্দ্রীকৃত কাঠামো বিভিন্ন অঞ্চলে সমন্বিতভাবে ও দ্রুত হামলা চালাতে সহায়তা করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরাক ও সিরিয়া থেকে আইএস-এর কাছ থেকে পাওয়া সমর্থন জঙ্গিদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই সমর্থন তাদের কৌশল পরিবর্তনে সহায়তা করছে, যার মধ্যে রয়েছে রাতের বেলা হামলা, হালকা ও কার্যকর অস্ত্রের ব্যবহার এবং বিস্ফোরক যুক্ত বাণিজ্যিক ড্রোন ব্যবহার করা।
**সামরিক বাহিনীর দুর্বলতা**
বর্নোর ডিকওয়া অঞ্চলের সামরিক কার্যক্রমের সাথে পরিচিত এক স্থানীয় এনজিও কর্মী আলী আবানি জানান, সেনাবাহিনীর ঘাঁটিগুলোতে পর্যাপ্ত জনবল নেই এবং ঘাঁটিগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় তা হামলার জন্য দুর্বল হয়ে পড়ে।
তিনি আরও জানান, “যখন জঙ্গিরা আসে, তখন তারা সহজেই সেনাদের পরাস্ত করতে সক্ষম হয়।”
প্রায়ই দেখা যায়, অতিরিক্ত সেনা বা আকাশ পথের সাহায্য আসতে দেরি হয়, ফলে জঙ্গিরা অস্ত্রশস্ত্র লুট করে নিয়ে যায়।
আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো, আত্মসমর্পণ করা জঙ্গিরাও এখনও খবর সরবরাহকারী এবং রসদ সরবরাহকারীর কাজ করছে।
**আগের পরিস্থিতি ফিরে আসার শঙ্কা**
২০১৩ ও ২০১৪ সালে বোকো হারামের সদস্যরা তাদের ক্ষমতার শীর্ষে ছিল।
সেসময় তারা প্রায় বেলজিয়ামের সমান এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল।
এমনকি, তারা ২৭৬ জন স্কুলছাত্রীকে অপহরণ করে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করে।
সামরিক অভিযানের কারণে তারা তাদের অনেক এলাকা হারালেও, সাম্প্রতিক হামলাগুলো আবারও সেই খারাপ দিনগুলোর স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে।
বর্নো রাজ্যের গভর্নর বাবাগানা জুলুম সম্প্রতি সতর্ক করে বলেছেন, সামরিক ঘাঁটিগুলো প্রায় প্রতিদিনই জঙ্গিদের আক্রমণের শিকার হচ্ছে।
নাইজেরিয়ার আইনপ্রণেতারাও জঙ্গিদের অত্যাধুনিক অস্ত্র ও কৌশলের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সেনাবাহিনীর সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বিষয়টি নিয়ে নাইজেরিয়ার সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে জানা গেছে, ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তারা সম্প্রতি ক্যামেরুন সীমান্তের কাছে অবস্থিত গামবোরু এলাকা পরিদর্শন করেছেন এবং বোকো হারামের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আরও সেনা মোতায়েনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম।