মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বন্ড নাকি শেয়ার, কে আনবে আসন্ন সংকট?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্ড বাজারে দেখা দেওয়া অস্থিরতা, যা অর্থনীতির জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্ড মার্কেট বা ঋণপত্রের বাজারে হঠাৎ করে দরপতন, যা সাধারণত অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে দেখা যায় না, তা এখন অনেক অর্থনীতিবিদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে।

তাদের মতে, এই পরিস্থিতি আসন্ন অর্থনৈতিক সংকটের পূর্বাভাস দিতে পারে। খবর অনুযায়ী, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতি এক্ষেত্রে বিশেষভাবে দায়ী।

বন্ড, যা সরকার বা কর্পোরেশনকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঋণ দেওয়ার একটি উপায়, সাধারণত শেয়ার বাজারের চেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশেষ করে, মার্কিন ট্রেজারি বন্ডগুলি নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারীদের কাছে পরিচিত।

কারণ, এর পেছনে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সরকার ও অর্থনীতির সমর্থন রয়েছে। অর্থনৈতিক অস্থিরতার সময়ে, যখন শেয়ারের দাম কমে, তখন ট্রেজারি বন্ডের দাম বাড়ে। কিন্তু সম্প্রতি এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে।

গত ২ এপ্রিল, ট্রাম্প বেশ কয়েকটি দেশের ওপর শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ার পর, বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদী মার্কিন ট্রেজারি বন্ড বিক্রি করতে শুরু করে। এর ফলে বন্ডের সুদ-হার দ্রুত বেড়ে যায়।

সাধারণত এমন পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বন্ডের দিকে ঝোঁকে, কিন্তু এখানে উল্টো চিত্র দেখা গেছে। বন্ডের দর পতনের সঙ্গে সঙ্গে শেয়ার বাজারেরও ক্ষতি হয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, বন্ড মার্কেটের এই অস্থিরতা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুতর সতর্কবার্তা। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বিনিয়োগকারীরা সম্ভবত মনে করছেন, ওয়াশিংটন দীর্ঘমেয়াদে তাদের ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না।

এর ফলস্বরূপ, সরকারের ঋণ নেওয়ার খরচ বাড়বে এবং জাতীয় ঋণের বোঝা আরও বাড়বে, যা বর্তমানে প্রায় ৩৬.২২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। এছাড়া, নাগরিকদের এবং ব্যাংকগুলোর ঋণ নেওয়ার খরচও বাড়বে, যা সামগ্রিক আর্থিক ব্যবস্থাপনার জন্য উদ্বেগের কারণ।

ক্যালিফোর্নিয়া-বার্কলের হাস স্কুল অফ বিজনেসের অধ্যাপক আনাস্তাসিয়া ফেডেক এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমার মনে হয়, এটা উদ্বেগের একটি গুরুতর সূচক। বিনিয়োগকারীরা হয়তো এখনই মনে করছেন না যে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না, তবে তারা মার্কিন অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন।

বন্ড বাজারের এই পরিবর্তন যে সরকারের নীতি পরিবর্তনে প্রভাব ফেলতে পারে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে। বন্ডের সুদ-হার বেড়ে যাওয়ায় তিনি মাত্র ৪৯ দিনের মাথায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেও বন্ড বাজারের এই অস্থিরতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “বন্ড মার্কেট খুবই জটিল।” যদিও তার ঘোষণার পর ট্রেজারি বন্ডের সুদ-হার কিছুটা কমেছে, তবে তা আগের তুলনায় এখনো বেশি।

বর্তমানে, ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধ এবং শুল্ক নীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। গত সপ্তাহে চীন থেকে আমদানি করা সেমিকন্ডাক্টর ও ওষুধ পণ্যের ওপর নতুন শুল্ক আরোপের তদন্ত শুরু হয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে, বন্ড বাজারের এই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। অধ্যাপক ফেডেক মনে করেন, “এই অনিশ্চয়তা বাজারের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা। বাণিজ্য নীতির কারণে এত বেশি পরিবর্তন হচ্ছে যে, বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন এবং ফেডারেল রিজার্ভও নীতিনির্ধারণে সমস্যায় পড়ছে।

মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট অবশ্য বন্ড বাজারের দরপতনকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে রাজি নন। তিনি বলেছেন, পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তাদের যথেষ্ট ব্যবস্থা রয়েছে। ফেডেক আরও যোগ করেন, “ফেডারেল রিজার্ভের হাতে পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার মতো অনেক কৌশল আছে, যেমন কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং-এর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী মার্কিন সরকারি ঋণ ক্রয় করা।

এই পরিস্থিতিতে, যুক্তরাষ্ট্রের বন্ড বাজারের এই অস্থিরতা বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি সতর্কবার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *