ইতালির ভেনিসের কাছে অবস্থিত মুরানো দ্বীপ, কাঁচশিল্পের জন্য বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত। শত শত বছর ধরে এখানে তৈরি হচ্ছে অসাধারণ সব কাঁচের জিনিস।
কিন্তু এই শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন অনেকেই সন্দিহান, ঠিক তখনই এক ভিন্ন গল্প শোনা যায়। রবার্তো বেলট্রামি নামের এক তরুণ, যিনি পদার্থবিদ্যার ছাত্র ছিলেন, বোস্টনে কাঁচশিল্পের আকর্ষণ অনুভব করেন এবং পরে মুরানোর ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে নতুন করে জাগিয়ে তোলার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন।
বেলট্রামির জন্ম ইতালির ব্রেশিয়া শহরে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ভেনিসের কাছাকাছি মুরানোর কাঁচশিল্পের খ্যাতি শুনে বড় হয়েছেন।
তবে কাঁচের প্রতি তার ভালোবাসা তৈরি হয় সুদূর আমেরিকাতে, বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। সেখানে তিনি শিল্পী ডেল চিহুলির কাঁচের কাজ দেখে মুগ্ধ হন। কাঁচের রং, স্বচ্ছতা ও বিভিন্ন আকার তাকে এতটাই আকৃষ্ট করে যে, তিনি এই শিল্পের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
২০১১ সালে, বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার ছাত্র থাকাকালীন, বেলট্রামি গ্রীষ্মের ছুটিতে মুরানোতে যান এবং সেখানে কাঁচ তৈরির প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেন। সেই প্রশিক্ষণ একসময় শিক্ষানবিশে পরিণত হয়।
এরপর তিনি পড়াশোনা ছেড়ে দেন এবং ঐতিহ্যপূর্ণ কর্মশালায় কাজ করতে শুরু করেন। এখানে তিনি বিশ্বের সেরা কাঁচশিল্পীদের কাছ থেকে হাতে-কলমে কাজ শেখেন।
মুরানোর কাঁচশিল্পের ৭০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্য রয়েছে। একসময় এটি ছিল কাঁচশিল্পের কেন্দ্র, যা তাদের গুণমান, শৈলী এবং উদ্ভাবনের জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত ছিল।
এখানকার কারিগররা ‘ক্রিস্টালো’ নামে স্বচ্ছ কাঁচ তৈরির কৌশল উদ্ভাবন করে খ্যাতি অর্জন করেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই শিল্প বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। বিশেষ করে, কম বয়সী শ্রমিকদের এই কঠিন ও শ্রমসাধ্য কাজে আগ্রহ কমে যাওয়ায় অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
বেলট্রামি জানান, মুরানোর কর্মশালাগুলো সাধারণত তাদের গোপন কৌশল সহজে কারো সাথে ভাগ করতে চাইত না। কারণ, তারা মনে করত এতে তাদের ব্যবসার ক্ষতি হবে।
তাই নতুন করে এই শিল্পে আসা তরুণদের জন্য শেখার সুযোগ ছিল খুবই সীমিত। এই প্রতিকূলতার মধ্যে, বেলট্রামি নিজের পথ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন।
২০১৭ সালে, মাত্র ২৫ বছর বয়সে, তিনি ‘ওয়েভ মুরানো গ্লাস’ নামে নিজের কর্মশালা শুরু করেন। বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠানে ২০ জনের একটি দল কাজ করে, যাদের বেশিরভাগই তরুণ।
বেলট্রামি সম্ভবত মুরানোর সবচেয়ে কম বয়সী মাস্টার গ্লাসমেকার। তার এই উদ্যোগ পুরনো এই শিল্পকে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে।
কাঁচ তৈরির প্রক্রিয়া বেশ জটিল। প্রায় ১,৬০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বালি, সোডা অ্যাশ এবং চুনাপাথর গলিয়ে কাঁচ তৈরি করা হয়।
এরপর গলিত কাঁচকে একটি নলের সাহায্যে সংগ্রহ করে, ফুঁ দিয়ে নির্দিষ্ট আকার দেওয়া হয়। মুরানোর কারিগররা রঙিন কাঁচ তৈরি করতেও পারদর্শী, যা তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
বিভিন্ন রঙের কাঁচ একসাথে মিশিয়ে কাজ করা বেশ কঠিন, কারণ প্রতিটি রঙের জন্য আলাদা উপাদানের প্রয়োজন হয়। নীল রঙের জন্য কোবাল্ট, হালকা হলুদ রঙের জন্য সিসা এবং গোলাপী রঙের জন্য টেলুরিয়াম ব্যবহার করা হয়।
বেলট্রামি ছোটবেলায় ঘরোয়া পরিবেশে একবার সোফা পুড়িয়ে ফেলেন, যা তার আগুন নিয়ে ভালোবাসার প্রমাণ। তিনি মনে করেন, কাঁচ তৈরি একটি দলগত খেলা, যেখানে শারীরিক পরিশ্রমের পাশাপাশি দলবদ্ধভাবে কাজ করার প্রয়োজন হয়।
কারণ, কাঁচের বড় আকারের জিনিস তৈরি করতে কমপক্ষে কয়েকজন মানুষের প্রয়োজন হয়। একজন কাঁচটিকে ধরে রাখেন, অন্যজন সেটিকে আকার দেন এবং কেউ কেউ সেটিকে গরম রাখার জন্য কাজ করেন।
একসময় মুরানোতে ৩০,০০০ এর বেশি মানুষ বাস করত, কিন্তু বর্তমানে সেখানে প্রায় ৪,০০০ মানুষের বসবাস।
মুরানো গ্লাসকে বাঁচিয়ে রাখতে বেলট্রামি আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেছেন। তিনি প্রশাসনিক কাজ সহজ করার জন্য এআই-নির্ভর সফটওয়্যার ব্যবহার করেন এবং শক্তি সাশ্রয়ী চুল্লি স্থাপন করেছেন।
এই চুল্লিগুলো পুরনো চুল্লির তুলনায় প্রায় ৮০% কম গ্যাস ব্যবহার করে।
বেলট্রামি এখন পর্যন্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড, ডিজাইনার এবং শিল্পীর জন্য ‘হোয়াইট লেবেল’ পণ্য তৈরি করেছেন। এছাড়াও, তিনি কাঁচ তৈরির প্রশিক্ষণ এবং ভ্রমণের মাধ্যমে এই শিল্পের সাথে আরও বেশি মানুষকে যুক্ত করতে চান।
তার এই প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ, তিনি বিশ্বজুড়ে তরুণ এবং আগ্রহী কর্মীদের জন্য ইন্টার্নশিপের সুযোগ তৈরি করেছেন, যাদের অনেকেই এখন ওয়েভ মুরানো গ্লাসে কাজ করছেন।
বেলট্রামির মতে, ঐতিহ্যপূর্ণ কারুশিল্প, এক হাজার বছরের বেশি পুরনো ইতিহাস এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা এই শিল্পকে বিশেষ করে তোলে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন