গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার এক ভয়াবহ চিত্র সম্প্রতি সামনে এসেছে, যা পরিবেশবিদদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। এই পদ্ধতিতে, বিশাল লোহার জাল সমুদ্রের তলদেশে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়, যার ফলে এর পথে আসা সবকিছু – মাছ থেকে শুরু করে অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী – নির্বিচারে ধরা পড়ে।
এই ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়ার কারণে সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একটি নতুন তথ্যচিত্রে এই গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে।
খ্যাতিমান প্রকৃতিবিদ স্যার ডেভিড অ্যাটেনবরো এই তথ্যচিত্রে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার পদ্ধতিটিকে “অত্যন্ত অপচয়কারী” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তার মতে, ট্রলারের জালে ধরা পড়া মাছের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি ফেলে দেওয়া হয়, যা সমুদ্রের জীববৈচিত্র্যের জন্য চরম ক্ষতিকর।
এই পদ্ধতিতে মাছ ধরার ফলে সমুদ্রের তলদেশের বিশাল এলাকা ধ্বংস হয়ে যায়।
গবেষকদের মতে, প্রতি বছর অ্যামাজন জঙ্গলের সমান একটি এলাকার সমুদ্রতল এই কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। শুধু তাই নয়, এই প্রক্রিয়া জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলে।
গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার কারণে প্রতি বছর প্রায় ৩৭ কোটি মেট্রিক টন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয়, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখে।
গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার ফলে অনেক সামুদ্রিক প্রজাতি, যেমন – প্রবাল এবং স্পঞ্জ, তাদের আবাসস্থল হারায়। এই প্রজাতিগুলোর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
যদিও গভীর সমুদ্রে মাছ ধরায় ব্যবহৃত জালগুলি বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরে, তবে এর মধ্যে প্রায় এক চতুর্থাংশ বন্য মাছ ধরা হয়। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন যে, আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ ধরার আগে সমুদ্রে যে পরিমাণ বড় আকারের মাছ ছিল, বর্তমানে তার মাত্র ১০ শতাংশ অবশিষ্ট আছে।
তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, অনেক সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকাতেও এই ধরনের মাছ ধরার অনুমতি দেওয়া হয়। পরিবেশবিদ এবং বিজ্ঞানীরা এই বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং এর প্রতিকারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা বলছেন।
এই সমস্যার সমাধানে সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা তৈরি করা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। এই সংরক্ষিত এলাকাগুলোতে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হলে, সেখানকার মাছ এবং অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং তা আশেপাশের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়বে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে হলে বিশ্বের অন্তত ৩০ শতাংশ এলাকাকে মাছ ধরা থেকে সম্পূর্ণরূপে রক্ষা করতে হবে। বর্তমানে, এই ধরনের সংরক্ষিত এলাকার পরিমাণ মাত্র ৩ শতাংশ।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের এই তথ্যচিত্রের মাধ্যমে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে। পরিবেশবিদ এবং বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, আসন্ন জাতিসংঘ মহাসাগর সম্মেলনে (United Nations Ocean Conference) এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, যা গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা বন্ধ করতে এবং সমুদ্রকে রক্ষার জন্য সহায়ক হবে।
এনরিক সালা, একজন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এক্সপ্লোরার এবং “ওশান উইথ ডেভিড অ্যাটেনবরো” তথ্যচিত্রের সহ-প্রযোজক, গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার প্রভাব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন।
তিনি এই ধ্বংসাত্মক পদ্ধতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন এবং মানুষকে সমুদ্র রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করার আহ্বান জানিয়েছেন।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক