বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ব্রায়ান উইলসন, যিনি ছিলেন বিচ বয়েজ ব্যান্ডের প্রধান মস্তিষ্ক, পপ সঙ্গীতের জগতে এক অসাধারণ প্রতিভা হিসেবে আজও স্মরণীয়। ১৯৬০-এর দশকে সার্ফ মিউজিক দিয়ে যাত্রা শুরু করে, তিনি সঙ্গীতের জটিলতা ও মাধুর্যকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
তাঁর সৃষ্টিশীলতা, সুরের গভীরতা এবং ব্যক্তিগত জীবনের নানা সংকট – সবই আজও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে এক আলোচনার বিষয়।
বিচ বয়েজের শুরুর দিকের গানগুলো, যেমন ‘সার্ফিন’ (Surfin’) সেই সময়ের জনপ্রিয় সার্ফ সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি ছিল। তবে ব্রায়ান উইলসন ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া।
তিনি দ্রুত গানের মান উন্নত করতে শুরু করেন। তাঁর ‘সার্ফিন’ ইউএসএ’ (Surfin’ USA) গানটি ছিল ক্যালifornিয়ার সুন্দর জীবন, খেলাধুলা এবং অবারিত আনন্দের এক উজ্জ্বল চিত্র।
গানের সরল সুরের মাঝেও ছিল কণ্ঠশিল্পের অসাধারণ মিশ্রণ, যা শ্রোতাদের মন জয় করে নেয়। যদিও বিচ বয়েজের সদস্যরা নিজেদের সেই আদর্শ জীবনের সাথে কতটা পরিচিত ছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
ব্রায়ান উইলসনের শৈশব ছিল কষ্টের। তাঁর বাবা ছিলেন কঠোর এবং একগুঁয়ে, যিনি ব্রায়ানকে ছোটবেলায় মারধর করতেন।
এই আঘাতের কারণে ব্রায়ানের একটি কানে শ্রবণশক্তি কমে গিয়েছিল। সম্ভবত এই কঠিন শৈশবই তাঁর গানের গভীরতা ও বেদনার কারণ ছিল।
তাঁর গানগুলোতে প্রায়ই ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ দেখা যেত, যা তাঁর শ্রোতাদের হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করে। ‘ইন মাই রুম’ (In My Room) গানটি তাঁর একাকীত্ব, উদ্বেগ এবং মানসিক শান্তির আকাঙ্ক্ষার এক চমৎকার উদাহরণ।
উইলসন সবসময়ই নতুন কিছু করার চেষ্টা করেছেন। বিটলসের মতো ব্যান্ড যখন সঙ্গীতের জগতে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করছিল, তখন তিনি আরো জটিল ও পরীক্ষামূলক সুর তৈরি করতে শুরু করেন।
‘ফান, ফান, ফান’ (Fun, Fun, Fun), ‘আই গেট এরাউন্ড’ (I Get Around), ‘ডান্স, ডান্স, ডান্স’ (Dance, Dance, Dance) এর মতো জনপ্রিয় গানগুলোর পাশাপাশি, তিনি প্রায়ই অ্যালবামের অন্য দিকে রাখতেন ‘দ্য ওয়ার্ম্থ অফ দ্য সান’ (The Warmth of the Sun), ‘শি নোজ মি টু ওয়েল’ (She Knows Me Too Well) এর মতো গভীর গান।
‘ডন্ট ওরি বেবি’ (Don’t Worry Baby) গানটিতে তিনি গাড়ির রেসিংয়ের গল্পকে আত্ম-সন্দেহ এবং ভালোবাসার মাধ্যমে পরিত্রাণের এক মর্মস্পর্শী অনুভূতির সঙ্গে গেঁথেছেন।
উইলসন একাধারে গান লিখতেন, সুর করতেন এবং প্রযোজনা করতেন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে তিনি নয়টি অ্যালবাম তৈরি করেন, যা তাঁর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর অনেক চাপ সৃষ্টি করে।
এই সময়ে তিনি ‘ক্যালিফোর্নিয়া গার্লস’ (California Girls) এর মতো গান তৈরি করেন, যা বিভিন্ন অঞ্চলের মেয়েদের সৌন্দর্যের বর্ণনা দেয়।
১৯৬৫ সালের ‘বিচ বয়েজ টুডে!’ (Beach Boys Today!) অ্যালবামটি ছিল তাঁর এক উল্লেখযোগ্য কাজ। এরপর তিনি স্টুডিওতে মনোনিবেশ করেন এবং গানের জটিলতা বাড়াতে থাকেন।
তাঁর তৈরি করা গানগুলো ছিল গভীর এবং আবেগপূর্ণ। এর ফলস্বরূপ, ১৯৬৬ সালে মুক্তি পায় ‘পেট সাউন্ডস’ (Pet Sounds) অ্যালবামটি, যা সঙ্গীতের ইতিহাসে এক মাইলফলক হিসেবে আজও স্বীকৃত।
‘ক্যারোলিন নো’ (Caroline No) এবং ‘গড অনলি নোজ’ (God Only Knows) এর মতো গানগুলো আজও শ্রোতাদের মুগ্ধ করে।
উিলসন ‘গুড ভাইব্রেশনস’ (Good Vibrations) গানটি তৈরি করতে প্রায় ছয় মাস সময় নিয়েছিলেন। এটি ছিল তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম।
গানটির জটিলতা এবং বিভিন্ন ধরনের অনুভূতির মিশ্রণ এটিকে পপ সঙ্গীতের ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান দিয়েছে।
উিলসন মানসিক স্বাস্থ্য এবং মাদকাসক্তির সঙ্গেও লড়াই করেছেন। ১৯৬৭ সালে ‘স্মাইল’ (Smile) নামের একটি অ্যালবাম তৈরির কাজ মাঝপথে বন্ধ করে দিতে হয়।
যদিও অ্যালবামটি পরে প্রকাশিত হয়েছিল, তবে এটি ১৯৬০-এর দশকের সঙ্গীতের ধারার থেকে বেশ আলাদা ছিল।
উইলসনের ব্যক্তিগত জীবনের সংকট তাঁর পেশাগত জীবনেও প্রভাব ফেলেছিল। বিচ বয়েজের সদস্যরা তাঁদের পুরোনো খ্যাতি ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন।
১৯৭০-এর দশকে, তিনি ‘সানফ্লাওয়ার’ (Sunflower), ‘সার্ফস আপ’ (Surf’s Up) এবং ‘হল্যান্ড’ (Holland) এর মতো অ্যালবাম তৈরি করেন, যেখানে তাঁর সৃজনশীলতা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
পরবর্তীতে, তিনি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে আসেন এবং ১৯৮০-এর দশকে ‘ব্রায়ানস ব্যাক’ (Brian’s Back) নামে একটি প্রচারণা শুরু করেন।
এই সময়ে তিনি নতুন করে অ্যালবাম তৈরি করেন এবং কনসার্টে অংশ নিতে শুরু করেন। যদিও তাঁর আগের মতো খ্যাতি ছিল না, তবে তাঁর গানগুলো আজও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে বিশেষভাবে আদৃত।
বর্তমানে ব্রায়ান উইলসন তাঁর পুরনো গানগুলো নিয়ে কনসার্ট করেন এবং সঙ্গীত জগতে তাঁর অবদান আজও স্মরণ করা হয়।
তাঁর সঙ্গীত, যা আনন্দ এবং বেদনার এক মিশ্রণ, পপ সঙ্গীতের ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান