ব্রিটিশ পাব: হেঁটে যাওয়া এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা!

ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে দূরের পাব: স্কটল্যান্ডের এক দুর্গম পথের গল্প।

স্কটল্যান্ডের ইনভারি গ্রামের এক প্রান্তে অবস্থিত ‘দ্য ওল্ড ফোর্জ’ (The Old Forge), যা ব্রিটেনের মূল ভূখণ্ডের সবচেয়ে দূরের পাব হিসেবে পরিচিত। এখানে পৌঁছানো কোনো সহজ কাজ নয়। এর জন্য পাড়ি দিতে হয় দুর্গম পথ, যা ট্রেকিং প্রেমীদের জন্য এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।

এই পাব-এর গল্প শুধু একটি পানশালার গল্প নয়, বরং এক দুর্গম অঞ্চলের মানুষের সংগ্রাম, ঐতিহ্য আর ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি।

লন্ডন থেকে ক্যালডোনিয়ান স্লিপারে চেপে শুরু হয় এই যাত্রা। রাতের ট্রেনে ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়ে, ভোরে ফোর্ট উইলিয়ামে নামতে হয়। এরপর ট্যাক্সি করে যাওয়া, কিনলক হর্ন পর্যন্ত।

এখান থেকেই আসল অভিযান শুরু। ১৫.২ মাইল পথ হেঁটে যেতে হয়, যা প্রায় ২৪.৫ কিলোমিটারের সমান।

পথটা সহজ ছিল না। কখনও পাথুরে, কখনও কাদা-মাটিতে ভরা পথ পেরিয়ে যাওয়া, আবার কখনও বা খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠা—এ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। চারপাশে সবুজের সমারোহ, মাঝে মাঝে পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণার আওয়াজ, আর দূরের নীল জলরাশি—প্রকৃতির এই রূপ ট্রেকিং-এর কষ্টকে ভুলিয়ে দেয়।

পথের ধারে দেখা মেলে স্কটিশ গরুর পালের। শান্ত, স্নিগ্ধ পরিবেশে তারা যেন বহুকাল ধরে এই জায়গার নীরব সাক্ষী। এই পথ পেরিয়ে যাওয়া মানে যেন প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়া।

স্কটল্যান্ডের এই অঞ্চলের ইতিহাসও বেশ গভীর। একসময় এই পথ ব্যবহৃত হতো গবাদি পশু এবং হরিণ শিকারিদের জন্য। এমনকি একসময় কফিন নিয়ে যাওয়ার রাস্তাও ছিল এটি।

একটা সময় ছিল যখন এখানকার মানুষজন তাদের বসতবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। ১৮ ও ১৯ শতকে ‘হাইল্যান্ড ক্লিয়ারেন্স’-এর নামে তাদের উচ্ছেদ করা হয়, যার ফলে অনেক মানুষ এই জায়গা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।

এর ফলস্বরূপ, এখানকার স্থানীয় সংস্কৃতিও একসময় বিলুপ্তির পথে চলে যায়।

বর্তমানে, এখানে মাত্র ১২০ জনের বসবাস। আধুনিক জীবনের কোলাহল থেকে দূরে, তারা তাদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।

এখানকার মানুষের মধ্যে রয়েছে একতা ও ভালোবাসার বন্ধন। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো, স্থানীয় মানুষেরা একত্রিত হয়ে ২০১৯ সালে ‘দ্য ওল্ড ফোর্জ’ কিনে নেয়।

এখানকার ম্যানেজারের নাম উইল ও’নিল। তিনি বলেন, “এটা আমাদের সকলের পাব। এখানে কাজ করাটা কঠিন, তবে আমরা সবাই ভালোবাসি।”

পাবটির ব্যবসার উন্নয়ন ব্যবস্থাপক, স্টেফানি হ্যারিস, যিনি কিন্ডিয়ার্টে বড় হয়েছেন, তিনি বলেন, “শেয়ারহোল্ডার হিসেবে পাবের ভবিষ্যৎ গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারাটা দারুণ। আমি আমার দক্ষতা দিয়ে পাবের উন্নতিতে অবদান রাখতে চাই।”

কষ্টের এই পথের শেষে যখন ‘দ্য ওল্ড ফোর্জ’-এ পৌঁছানো যায়, তখন সেখানকার উষ্ণ আতিথেয়তা মন ছুঁয়ে যায়।

পাবটি সাদামাটা হলেও ভেতরে রয়েছে উষ্ণতা। পর্যটকদের পাশাপাশি স্থানীয়দের আনাগোনাও চোখে পড়ে। এখানে বসে এক গ্লাস বিয়ার হাতে, ট্রেকিং-এর ক্লান্তি দূর করা যায়।

যদি আপনিও এই পাব-এ যাওয়ার পরিকল্পনা করেন, তাহলে কিছু প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। মানচিত্র, জিপিএস এবং পর্যাপ্ত খাবার ও জল সঙ্গে নিন।

আগে থেকে আপনার যাত্রা পথের পরিকল্পনা সম্পর্কে কাউকে জানিয়ে রাখুন। রাতে থাকার জন্য হালকা স্লিপিং ব্যাগ ও ম্যাট নেওয়া ভালো।

এখানে রাত্রিযাপনের জন্য ‘বারিসডেল বোথি’ (Barrisdale Bothy)-র মতো আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে থাকা যায়।

বোথিতে থাকার খরচ জনপ্রতি ৫ পাউন্ড, যা প্রায় ৬.৬৩ মার্কিন ডলার বা ৭০০ টাকার সমান।

এই পাব-এর গল্প শুধু একটি ভ্রমণ কাহিনি নয়, এটি একটি কমিউনিটির টিকে থাকার গল্প। প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, তারা তাদের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলের মানুষের কাছেও এই গল্প অনুপ্রেরণা জোগাতে পারে। আমাদের দেশেও এমন অনেক জনপদ রয়েছে, যেখানে মানুষজন তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে।

তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *