আর্ট জগতে কার্পেটের ব্যবহার: আনা পেরাচের মানবিক রূপ।
শিল্পকলার জগৎ প্রতিনিয়ত নতুনত্বের সন্ধানে ছুটে চলে। শিল্পী আনা পেরাচ তেমনই একজন, যিনি কার্পেটকে ব্যবহার করে তৈরি করছেন মানবিক অবয়ব। তাঁর শিল্পকর্ম একদিকে যেমন আকর্ষণীয়, তেমনই গভীর চিন্তাভাবনার জন্ম দেয় দর্শকদের মনে।
আনা পেরাচের জন্ম ইউক্রেনে, তবে বর্তমানে তিনি লন্ডনে বসবাস করেন। তাঁর কাজের মূল বিষয়বস্তু নারীত্ব, জাদু, এবং মানুষের ভেতরের অন্যরকম জগৎ। লোককথা ও রূপকথার জগৎ থেকে তিনি তাঁর কাজের উপাদান সংগ্রহ করেন।
আনা পেরাচের তৈরি করা কার্পেটের ভাস্কর্যগুলো দেখতে যেমন, তেমনই স্পর্শকাতর। এগুলোর বহুমাত্রিক গঠনশৈলী দর্শকদের আকৃষ্ট করে। তাঁর কাজ শরীর এবং পৃথিবীর মধ্যেকার সম্পর্ককে নতুনভাবে তুলে ধরে।
কার্পেটের স্পর্শ কোমলতা এক ধরনের আরামদায়ক অনুভূতি দেয়, যা একইসঙ্গে কিছুটা ভীতিও জাগায়। তাঁর কাজ আমাদের কল্পনার জগৎকে নাড়া দেয়, যেখানে একটি শরীরের উপস্থিতি অনুভব করা যায়।
আনা পেরাচের শৈশব কেটেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবে। সোভিয়েত নান্দনিকতা তাঁর কাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কার্পেটের প্রতি তাঁর এই বিশেষ আকর্ষণ শৈশব থেকেই।
তিনি জানান, কার্পেট সবসময়ই তাঁর কাছে পরিচিত একটি উপাদান, যা একইসঙ্গে আরামদায়ক এবং কিছুটা অচেনা। রাশিয়ার রুচি ও সংস্কৃতির ইতিহাসেও এর প্রভাব রয়েছে। প্রচুর কার্পেটের ব্যবহার তাঁর কাজের এক বিশেষ দিক।
বর্তমানে, আনা পেরাচ লন্ডনের রিচার্ড স্যালটন গ্যালারিতে একটি নতুন প্রদর্শনী করেছেন, যার নাম ‘এ লিপ অফ সিম্প্যাথি’। এই প্রদর্শনী ই.টি.এ. হফম্যানের গল্প ‘দ্য স্যান্ডম্যান’ থেকে অনুপ্রাণিত।
গল্পটি একজন মানুষ, তাঁর বাগদত্তা এবং একটি যন্ত্রমানবের ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনী নিয়ে গঠিত। এই প্রদর্শনীতে ভিক্টোরিয়ান পোশাকের আদলে তৈরি দুটি ভাস্কর্য রয়েছে।
এর মধ্যে একটির ভেতরে একজন মানুষ এবং অন্যটিতে একটি যন্ত্রমানব থাকবে। দর্শকদের মধ্যে দ্বিধা তৈরি করাই এই শিল্পকর্মের মূল উদ্দেশ্য।
আনা পেরাচের মতে, এই কাজগুলো সরাসরিভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (Artificial Intelligence) ধারণা থেকে অনুপ্রাণিত নয়, তবে প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং মানুষের মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে এটি প্রশ্ন তোলে।
তাঁর ভাষায়, “যন্ত্রমানব বা এআই-এর ভয় হলো, তারা আমাদের মানবিক ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, যা আমাদের নিজেদের মানবতা সম্পর্কেও নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।”
আনা পেরাচ তাঁর কাজে শিল্পী, কোরিওগ্রাফার, এবং শব্দনির্মাতা-সহ বিভিন্ন কলাকুশলীর সঙ্গে সহযোগিতা করেন। তিনি নিজেকে একজন পরিচালক হিসেবে বেশি দেখেন, যিনি বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্ম তৈরি করতে পারেন।
এই সহযোগিতার মাধ্যমে তিনি তাঁর কাজে বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা যুক্ত করেন।
আনা পেরাচের কাজ একদিকে যেমন চিরাচরিত শিল্পের সঙ্গে জড়িত, তেমনই আধুনিকতার ছোঁয়াও রয়েছে। তিনি কারুশিল্পকে শিল্পের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যান।
নারীদের ঐতিহ্যগতভাবে কারুশিল্পের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। কার্পেটের তৈরি তাঁর এই মূর্তিগুলো প্রমাণ করে, কীভাবে শিল্প মাধ্যমগুলো একটি নতুন স্থান তৈরি করতে পারে।
তিনি পূর্বে কাঁচের মতো বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করেছেন, তবে কার্পেটকে ছাড়তে চান না। তাঁর মতে, এই উপাদানটি নমনীয় এবং বহুভাবে ব্যবহার করা যায়।
আনা পেরাচ তাঁর কাজে ইতিহাসের দীর্ঘসূত্রিতা এবং জীবনের গভীরতা নিয়ে আসেন। তাঁর কাজ আমাদের সেই সব প্রশ্নের মুখোমুখি করে, যা আধুনিক বিশ্বে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তাঁর ভাষায়, “আত্মা ও বস্তুর মধ্যেকার বিভাজন আমাকে fascinate করে। আমি সেই আঘাতের স্থানে, সেই বিভাজনের স্থানে ফিরে যেতে চাই।”
আনা পেরাচের ‘এ লিপ অফ সিম্প্যাথি’ প্রদর্শনীটি লন্ডনের রিচার্ড স্যালটন গ্যালারিতে ১৫ই মে থেকে ২৪শে জুন পর্যন্ত চলবে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান