যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতির প্রেক্ষাপটে শিকাগো পুলিশের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসন সংক্রান্ত নীতির জেরে শিকাগো শহরে নতুন করে সংকট তৈরি হয়েছে। অভিবাসন বিরোধী অভিযান জোরদার করতে কেন্দ্রীয় সরকার সেখানকার স্থানীয় কর্তৃপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। এমন পরিস্থিতিতে শহরের পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তাদের জন্য পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। একদিকে যেমন শহরের নিরাপত্তা বজায় রাখতে হবে, তেমনই ফেডারেল ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সহযোগিতা করলে সাধারণ মানুষের আস্থা হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
শিকাগো কর্তৃপক্ষের জন্য এই চ্যালেঞ্জ নতুন নয়। এর আগে, লস অ্যাঞ্জেলেস এবং ওয়াশিংটন ডিসি-র মতো বড় শহরগুলোতেও একই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। সেখানকার পুলিশ বিভাগ ফেডারেল এজেন্সির সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি তৈরি করে। অনেক সময় পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যায়।
বর্তমানে শিকাগোও সেই একই পথে হাঁটছে। এই পরিস্থিতিতে ইলিনয়ের গভর্নর জেবি প্রিটজকার ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েনের বিরোধিতা করেছেন। শহরের কর্মকর্তারা ফেডারেল বাহিনীর উপস্থিতির কারণে পরিস্থিতির পরিবর্তন কীভাবে হবে, তা নিয়ে চিন্তিত। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অভিবাসী-অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে পুলিশের বিশ্বাসযোগ্যতা টিকিয়ে রাখাটা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ট্রাম্প প্রশাসন সম্ভবত তাদের উপর বেশি নজর দেবে।
আমেরিকান ইমিগ্রেশন কাউন্সিলের নীতি পরিচালক নায়না গুপ্তা বলেছেন, “ট্রাম্প প্রশাসন স্থানীয় ও ফেডারেল পুলিশের মধ্যেকার সম্পর্ককে দুর্বল করে দিচ্ছে। এছাড়া, এর ফলে সাধারণ মানুষ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে একটি বিভেদ তৈরি হচ্ছে, যা জননিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।”
শিকাগো শহর দীর্ঘদিন ধরেই আশ্রয় শহর হিসেবে পরিচিত। অভিবাসন সংক্রান্ত বিষয়ে স্থানীয় পুলিশকে সহযোগিতা না করার নীতি এখানে বহু বছর ধরে চলে আসছে। ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন নীতির কড়াকড়ি বাড়ার পরে, শিকাগোর মেয়র স্থানীয় পুলিশের কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি।
শিকাগোর নীতি অনুযায়ী, স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কারো অভিবাসন বিষয়ক তথ্য জানতে চাইতে পারবে না বা তাদের আটক করতে পারবে না। এছাড়াও, তারা কোনো অভিবাসন বিষয়ক অভিযানে সাহায্য করতে পারবে না, যেমন ধরুন, তল্লাশির সময় নিরাপত্তা দেওয়া বা অভিবাসীদের স্থানান্তর করা অথবা তাদের সম্পর্কে কোনো তথ্য জানানো যাবে না।
মেয়র ব্রান্ডন জনসন সম্প্রতি একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন। এই আদেশে বলা হয়েছে, শহরের পুলিশ কর্মীরা ফেডারেল ইমিগ্রেশন এজেন্টদের সঙ্গে কোনো সহযোগিতা করবে না। এছাড়া, শিকাগোর কর্মকর্তাদের ইউনিফর্ম পরতে হবে এবং তাদের মুখ ঢাকা বা মাস্ক পরাও চলবে না, যাতে তাদের ফেডারেল এজেন্টদের থেকে আলাদা করা যায়।
মেয়র জনসন বলেন, “আমরা আমাদের পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রেসিডেন্ট এর জন্য ট্রাফিক স্টপ বা চেকিংয়ের মতো কাজ করতে দেব না।”
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্রেগ ফুটারম্যানের মতে, ফেডারেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে স্থানীয় কর্মকর্তাদের সহযোগিতা জনসাধারণের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করে এবং সংস্থাগুলোর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে।
আশ্রয় শহরগুলোতে নীতিগুলি কীভাবে কাজ করে, বাস্তবে তা অনেক সময় জটিল হয়ে ওঠে।
নায়না গুপ্তা আরও বলেছেন, শিকাগো পুলিশকে ফেডারেল সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করতে হতে পারে, বিশেষ করে অভিবাসনবিরোধী অভিযান ও আটকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হলে।
বর্তমানে, শহরের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন যে তাঁরা ২০২৪ সালের ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কনভেনশনের সময় যে ধরনের পুলিশিং কৌশল ব্যবহার করেছিলেন, সেই একই কৌশল এখানেও প্রয়োগ করবেন। কনভেনশনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য শহরটির প্রায় ২৭ মিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা) অতিরিক্ত খরচ হয়েছিল।
৪ঠা জুন, ফেডারেল ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস)-এর সদস্যরা শিকাগোর একটি অভিবাসন অফিসে অন্তত ১০ জন বাসিন্দাকে আটক করে। এর প্রতিবাদে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বহু মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। কর্মকর্তাদের দাবি, প্রথমে তাঁরা বুঝতে পারেননি যে এটি একটি অভিবাসন বিষয়ক অভিযান ছিল এবং পরে তাঁরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
কিছু প্রতিবাদকারী এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ, শিকাগোর পুলিশ কর্মকর্তাদের আইস এজেন্টদের জন্য রাস্তা তৈরি করতে এবং তাদের গাড়িগুলোকে সুরক্ষা দিতে দেখা গেছে। এই ঘটনার পর শিকাগো সিটি কাউন্সিলের সদস্যরা কর্মকর্তাদের আচরণের অভ্যন্তরীণ তদন্তের দাবি জানান।
ক্যালিফোর্নিয়ায়ও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। সেখানে, কয়েকশ প্রতিবাদকারী ফেডারেল ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এর জেরে ট্রাম্প স্থানীয় কর্তৃপক্ষের আপত্তির পরেও লস অ্যাঞ্জেলেসে হাজার হাজার ন্যাশনাল গার্ড সদস্য মোতায়েন করেন।
রুটগার্স ইউনিভার্সিটি ল স্কুল এর অধ্যাপক রোজ কুইসন-ভিয়াজর বলেছেন, আশ্রয় শহরের নীতি মানে এই নয় যে, কোনো স্থানীয় পুলিশ অফিসার একজন আইস অফিসারের সঙ্গে কোনো অভিবাসীর মাঝে এসে দাঁড়াবে। এমনটা করলে তা বিচার বিভাগের কাজে বাধা দেওয়ার শামিল হবে।
তবে, ফেডারেল এজেন্টদের সঙ্গে প্রতিবাদকারীদের আচরণে যদি স্থানীয় কর্মকর্তাদের ভিন্নমত থাকে, সেক্ষেত্রে তারা হস্তক্ষেপ করতে পারবে কিনা, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তারা সন্ত্রাসবাদ, মাদক ও সংগঠিত অপরাধ দমনের জন্য ফেডারেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে অভ্যস্ত। কিন্তু শিকাগোতে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করা হলে তাদের ভূমিকা কী হবে, তা এখনো পরিষ্কার করা হয়নি।
ওয়াশিংটন ডি.সি.-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা পুলিশ এক্সিকিউটিভ রিসার্চ ফোরামের নির্বাহী পরিচালক চাক ওয়েক্সলার বলেছেন, ন্যাশনাল গার্ড সাধারণত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বড় ধরনের গোলযোগ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা করে থাকে। তবে, তাদের সরাসরি অপরাধ দমনের কাজে ব্যবহার করার নজির খুব একটা নেই।
শিকাগো পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট ল্যারি স্নেলিং ফেডারেল কর্তৃপক্ষের কাছে আরও বেশি যোগাযোগের আবেদন করেছেন, যাতে “মানুষের মধ্যে ভীতি তৈরি না হয় এবং শহরের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকে।”
ফিলাডেলফিয়ার জেলা অ্যাটর্নি ল্যারি ক্রাসনার বলেছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের ন্যাশনাল গার্ড ব্যবহারের সিদ্ধান্ত অপরাধের সফল বিচারকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। কারণ, এর ফলে সাক্ষীদের দেওয়া বক্তব্য বাতিল এবং প্রমাণগুলো অগ্রহণযোগ্য হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ বিভাগের প্রাক্তন প্রধান কেনেথ কোরি সতর্ক করেছেন, ন্যাশনাল গার্ডের মতো অতিরিক্ত নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হলে তাৎক্ষণিকভাবে অপরাধ কমে আসে, যা একটি ক্ষণস্থায়ী সমাধান।
কোরি আরও বলেন, “এ ধরনের পদক্ষেপ নিলে তাৎক্ষণিকভাবে অপরাধ কমে আসে, কারণ এর একটি প্রতিরোধমূলক প্রভাব থাকে। তবে সমস্যা হল, এটি বেশি দিন টেকে না। বাহিনী চলে গেলে অপরাধ আবার ফিরে আসে। আপনি তো অপরাধের মূল কারণগুলো সমাধান করলেন না।”
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস