চিলির এই দুর্গম স্থানে: বরফের চূড়া, ফিয়র্ড আর সবুজ বন!

পৃথিবীর শেষ প্রান্ত: চিলির তুষারাবৃত ভূমি ও ফিয়োর্ডের অনবদ্য সৌন্দর্য।

দক্ষিণ আমেরিকার একেবারে প্রান্তে, চিলির তুষারাবৃত পর্বতমালা, গভীর ফিয়োর্ড আর সবুজ অরণ্যে ঘেরা এক মনোমুগ্ধকর স্থান— তিয়েরা দেল ফুয়েগো (Tierra del Fuego)। সম্প্রতি, ভ্রমণ বিষয়ক একটি পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই অঞ্চলের দুর্লভ সৌন্দর্যের কথা তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে প্রকৃতির অপরূপ শোভা আর মানুষের জীবনযাত্রার এক বিরল চিত্র ফুটে উঠেছে।

প্যাটাগোনিয়ার এই অঞ্চলে, জার্মেন গেনস্কোওস্কি নামের একজন ব্যক্তির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৮৫ সালে তিনি এবং তাঁর পরিবার এখানে বসতি স্থাপন করেন। কঠিন পরিশ্রমের পর, স্থানীয় কাঠ ব্যবহার করে তিনি একটি কুটির তৈরি করেন।

দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনা ছিল এক দুঃসাধ্য কাজ। মূল ভূখণ্ড থেকে নৌকায় করে প্রথমে পুন্তা অ্যারেনাস (Punta Arenas) বন্দরে পৌঁছতে হতো, এরপর সেখান থেকে আরও একদিনের পথ পাড়ি দিয়ে আজোপার্দো নদীর তীরে, যেখানে একসময় তাঁর বাবা কাঠ কাটার কাজ করতেন।

গেনস্কোওস্কির কুটির থেকে নিকটতম জনবসতি ছিল ঘোড়ায় চড়ে তিন দিনের পথ।

গেনস্কোওস্কি একা থাকতেন, আর তাঁর স্ত্রী ও সন্তান শীতকালে পুন্তা অ্যারেনাসে ফিরে যেতেন। গভীর তুষারের চাদরে ঢাকা থাকত চারপাশ। বর্তমানে, তিনি এই অঞ্চলের শেষ বাসিন্দাদের একজন হিসেবে পরিচিত।

পর্যটকদের একটি দল, ‘এক্সপ্লোরা’ (Explora) নামক একটি ভ্রমণ সংস্থার তত্ত্বাবধানে তিয়েরা দেল ফুয়েগো ভ্রমণ করেন। এই ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে গেনস্কোওস্কি জানান, ২০০৪ সালে যখন তাঁর বাড়ির কাছে একটি রাস্তা তৈরি হয়, তখন তিনি খুব একটা খুশি হননি।

তাঁর মতে, “যেমন চলছিল, তাতেই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন।”

এই অঞ্চলে জীবনযাত্রা এখন আগের চেয়ে সহজ হয়েছে, যা গেনস্কোওস্কির জন্য অবশ্যই স্বস্তিদায়ক। কারণ, এক দশক আগে ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে তিনি আহত হয়েছিলেন।

তবে, এখানকার আসল আকর্ষণ তো সহজ জীবন নয়, বরং প্রকৃতির অকৃত্রিম রূপ ও নির্জনতা। পর্যটকদের দল যখন এই অঞ্চলে ভ্রমণ শুরু করে, তখন তাঁদের গাইড একটি পুরনো চিলীয় প্রবাদ শোনান: “Quien se apura en la Patagonia, pierde su tiempo”—অর্থাৎ, “যে ব্যক্তি প্যাটাগোনিয়ায় তাড়াহুড়ো করে, সে তার সময় নষ্ট করে।”

ভ্রমণের শুরুতে, তাঁরা পুন্তা অ্যারেনাসের একটি হোটেলে মিলিত হন। এরপর, ম্যাজেলান প্রণালী (Strait of Magellan) পাড়ি দিয়ে তিয়েরা দেল ফুয়েগোর দিকে যাত্রা শুরু করেন।

এই যাত্রাপথে ছিল বিস্তীর্ণ তৃণভূমি, যা ‘পাম্পাস’ নামে পরিচিত। এছাড়াও, এখানকার আদিবাসী ‘সেল্কনাম’ সম্প্রদায়ের ইতিহাসও তাঁদের ভ্রমণের একটি অংশ ছিল।

পর্যটকদের দলটি গেনস্কোওস্কির কুটিরে কয়েক দিন কাটান। সেখানে তাঁরা স্থানীয় খাবার ও আতিথেয়তার স্বাদ গ্রহণ করেন।

ভোরে তাঁরা একটি মাছ ধরার নৌকায় চড়ে ‘অ্যাডমিরালিটি সাউন্ড’ (Admiralty Sound) এবং ‘প্যারি বে’-র (Parry Bay) দিকে যাত্রা করেন। বরফের পাহাড় আর গভীর ফিয়োর্ডের দৃশ্য তাঁদের মুগ্ধ করে।

এক পর্যটকের কথায়, “এই জায়গাটি প্রতি বছর বদলায়। এখানে অনেক কিছুই ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।” জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখানে স্পষ্ট। গেনস্কোওস্কি জানান, একসময় এপ্রিল মাস থেকে ভারী তুষারপাত শুরু হতো, কিন্তু এখন আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটেছে।

পরিবর্তন সবসময় খারাপ নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এখানে নতুন জাতীয় উদ্যান তৈরি হয়েছে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে, সেল্কনাম সম্প্রদায়ের মানুষ সরকারিভাবে চিলির আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

গেনস্কোওস্কি আশঙ্কা করেন, পর্যটকদের আনাগোনায় হয়তো এই অঞ্চলের শান্ত পরিবেশ বিঘ্নিত হবে। তবে, প্রকৃতির কোলে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত ছিল তাঁর কাছে মূল্যবান।

সবুজ ঘাস, নীল জলরাশি আর তুষারাবৃত পাহাড়ের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য— তিয়েরা দেল ফুয়েগোর সৌন্দর্য ভ্রমণকারীদের মন জয় করে নেয়।

তথ্য সূত্র: ট্রাভেল + লেজার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *