হারিয়ে যাওয়া লেখার জগৎ: হতাশায় জর্জরিত আদিচির ফিরে আসার গল্প!

বিখ্যাত নাইজেরীয় লেখিকা চিমানন্দা এনগোজি আদিচি, যিনি “পার্পল হিবিস্কাস”, “আমেরিকানাহ” এবং “হাফ অফ এ ইয়েলো সান”-এর মতো উপন্যাসগুলির জন্য সুপরিচিত, তিনি কয়েক বছর ধরে এক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন। সৃজনশীলতার জগতে, এমনকি সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রও কখনো কখনো স্তব্ধ হয়ে যায়।

আদিচির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। গভীর হতাশা, আত্ম-সন্দেহ এবং তাঁর অন্তরের গল্পগুলো যেন বন্দী হয়ে গিয়েছিল—এমন এক অনুভূতি তাঁকে গ্রাস করেছিল।

এই নীরবতা ভেঙে তিনি ফিরে এসেছেন তাঁর নতুন উপন্যাস “ড্রিম কাউন্ট” নিয়ে। এক দশকের বেশি সময়ের বিরতির পর, এই উপন্যাসটি যেন তাঁর সৃজনশীল জীবনের পুনর্জন্ম।

তবে এই পর্যায়ে পৌঁছানো সহজ ছিল না। এর পেছনে ছিল কঠিন এক অধ্যায়।

চিমানন্দা এনগোজি আদিচি সিএনএন-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, “যে বছরগুলোতে আমি লিখতে পারিনি, সে সময় আমি গভীর হতাশায় ভুগছিলাম।

যখন আপনি লিখতে ভালোবাসেন, আর সেই ভালোবাসার জিনিসটিই যখন করতে পারেন না, তখন সেটা খুবই কষ্টের।”

৪৭ বছর বয়সী এই নাইজেরীয় লেখকের জীবনে লেখক জীবনের ছন্দপতন ঘটেছিল, যার মূল কারণ ছিল ব্যক্তিগত কিছু সংকট।

২০১৫ সালে তাঁর বাবার অপহরণ, বাবা-মায়ের মৃত্যু এবং মাতৃত্বের মতো বিষয়গুলো তাঁর প্রধান সৃজনশীল মাধ্যম, অর্থাৎ উপন্যাস লেখাকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছিল।

তিনি নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করেছিলেন। বক্তৃতার জন্য আগের চেয়ে বেশি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন, হয়তো ভেবেছিলেন এতে করে নতুন কোনো অনুপ্রেরণা আসবে।

কিন্তু তেমনটা হয়নি। বরং তিনি বাড়ি ফিরে “দুঃখ” অনুভব করতেন।

এই সময়ে কবিতা ছিল তাঁর আশ্রয়। কবিতার গভীরতা, ভাষার মাধুর্য তাঁকে লেখার সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল।

“আমি সেই সময়ে অনেক কবিতা পড়েছি, কারণ আমি মনে করি কবিতা ভাষার জন্য খুবই সহায়ক। এটি আমাকে লেখার ছন্দ ও তাল-এর সঙ্গে যুক্ত রেখেছিল।”

বর্তমানে আদিচি ফিরে এসেছেন “ড্রিম কাউন্ট” নিয়ে। এই উপন্যাসে চারটি আফ্রিকান নারীর—চিয়ামাকা, জিকরা, কাদিআতো এবং ওমেলোগোর—জীবনকে তুলে ধরা হয়েছে।

কোভিড-১৯ মহামারীর প্রেক্ষাপটে রচিত এই উপন্যাসটি ব্যক্তিগত শোক এবং তাঁর বাবা-মায়ের মৃত্যু দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত।

তাঁর বাবা ২০২০ সালের জুন মাসে কিডনি বিকল হয়ে মারা যান এবং মা তাঁর এক বছরের মধ্যেই—যদিও তাঁর মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি।

আদিচি তাঁর আগের কাজগুলো থেকে এই উপন্যাসটিকে আলাদা বলে মনে করেন।

“পার্পল হিবিস্কাস” এবং তাঁর আগের ছোট গল্পগুলোতে যে সংক্ষিপ্ত শৈলী ছিল, তা এখন আরও বিস্তৃত হয়েছে।

তিনি বলেন, “আমার মনে হয়, আমার বাক্যগুলো এখন দীর্ঘ। আমি একটু বেশি স্বাধীনতা নিতে চাই।

জীবন খুব ছোট—সবকিছু একসঙ্গে মিশিয়ে দাও, অতি-আবেগ নিয়ে বাঁচো! আপনি জানেন না আগামীকাল কী হবে, তাই এখনই সবটা করে ফেলুন।”

কবিতার প্রতি তাঁর ভালোবাসা “ড্রিম কাউন্ট”-কে দিয়েছে এক নতুন সুর, যা তাঁর সৃজনশীল কণ্ঠকে আরও উজ্জ্বল করেছে।

আদিচি বলেন, “যখন শব্দগুলো অবশেষে ফিরে এল, তারা এক নতুন কণ্ঠে আত্মপ্রকাশ করল।”

যে কণ্ঠ হারিয়ে যাওয়ার ভয় ছিল, তা আবার ফিরে এসেছে নতুন প্রাণ নিয়ে।

এখন, বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর, আদিচি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন—উপন্যাসটি শেষ করার জন্য, পাঠকদের কাছে পৌঁছানোর জন্য এবং নিজের সৃজনশীল সত্তাকে পুনরায় আবিষ্কার করার জন্য।

তিনি বলেন, “আমার আসল সত্তা হল সেই সত্তা, যা গল্প লেখে। আমি কৃতজ্ঞ যে এটি আবার ফিরে এসেছে।”

তাঁর এই যাত্রা অন্যান্য সৃজনশীল মানুষের জন্য সতর্কবার্তা এবং একইসঙ্গে অনুপ্রেরণা।

সতর্কবার্তা হলো—সৃজনশীল শূন্যতা খুবই কষ্টের হতে পারে, আর এই বিষয়ে কিছু গোপন করলে কোনো লাভ নেই।

অনুপ্রেরণা হলো—এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব, এবং নিজের কাজ ফিরে আসবে তার নিজস্ব সময়ে।

তাঁর পরামর্শ, “আমাদের প্রধান দায়িত্ব হল সৃষ্টি করা। যদি কঠিনও হয়, লেগে থাকুন।

আমাদের হতাশ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”

আদিচির জন্য, “ড্রিম কাউন্ট”-এর প্রকাশ নিছক একটি বই প্রকাশ নয়—এটি আত্ম-পুনরুদ্ধার।

আর যারা নিজেদের নীরবতার সময় পার করছেন, তাঁদের জন্য তাঁর গল্পটি একটি স্মরণিকা যে—অন্ধকারেও নতুন কাজের বীজ বোনা যায়, যা সঠিক সময়ে ফুল হয়ে ফোটে।

তথ্যসূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *