চীনের মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার দৌত্য, ইসরাইল-ইরান দ্বন্দ্বে নতুন সমীকরণ?
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা যখন বাড়ছে, তখন এই অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনতে এগিয়ে এসেছে চীন। গত সপ্তাহে ইসরাইলের নজিরবিহীন ইরান আক্রমণের পর চীন এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে নিজেদেরকে সম্ভাব্য শান্তি স্থাপনকারী হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। একইসঙ্গে তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবের বিপরীতে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে চাইছে।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই শনিবার ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে পৃথকভাবে টেলিফোনে কথা বলেছেন। তিনি ইসরাইলের হামলাকে স্পষ্টভাবে নিন্দা করে এই সংকটের সমাধানে ‘গঠনমূলক ভূমিকা’ পালনের প্রস্তাব দিয়েছেন। বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ওয়াং ই ইরানের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় সমর্থন জানিয়েছেন।
চীনের এই পদক্ষেপ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তাদের নেওয়া অবস্থান থেকে ভিন্ন। ইউক্রেন ইস্যুতে চীন সরাসরি রাশিয়ার নিন্দা করতে রাজি হয়নি, বরং মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করেছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যে চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তারের এটি একটি সুযোগ।
গত শুক্রবার ইসরাইল ইরানের সামরিক স্থাপনায় হামলা চালায়। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এটিকে ইরানের প্রতি তাঁর দেশের টিকে থাকার জন্য হুমকি মোকাবিলায় একটি পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এরপর উভয়পক্ষের মধ্যে প্রতিশোধমূলক হামলায় হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে। এতে এই অঞ্চলে একটি বড় ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত শুধু ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার বিরুদ্ধে ইসরাইলের প্রতিরক্ষায় সহায়তা করেছে।
চীনের নীতিনির্ধারকদের মতে, এই পরিস্থিতিতে তারা সরব হওয়ার যথেষ্ট কারণ খুঁজে পেয়েছে। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যে তাদের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব বাড়ছে। বিশেষ করে, ট্রাম্প প্রশাসনের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যগত অবস্থান দুর্বল হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে চীন বৃহত্তর পরিসরে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ দেখছে। চীনের এই পদক্ষেপের মাধ্যমে তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তাদের অবস্থান আরও সুসংহত করতে চাইছে।
চীন দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগী। সম্প্রতি তারা ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করেছে। এর মধ্যে যৌথ নৌ মহড়া উল্লেখযোগ্য। একইসঙ্গে চীন সৌদি আরবের মতো দেশগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক বজায় রাখতে চাইছে। চীনের কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করে আসছেন। তাঁরা ২০১৫ সালের ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়া নিয়েও সমালোচনা করেছেন এবং ওয়াশিংটনকে এই অঞ্চলের অস্থিরতা ও উত্তেজনার জন্য দায়ী করেছেন।
শনিবার ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনালাপে ওয়াং ই ইঙ্গিতপূর্ণভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে বলেন, ‘চীন ইসরাইলের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী দেশগুলোকে শান্তির জন্য বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘চীন ইরানের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখতে এবং পরিস্থিতি শান্ত করতে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত।’
একই দিনে ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডিওন সারের সঙ্গে কথা বলার সময় ওয়াং ই দুই দেশকে আলোচনার মাধ্যমে মতপার্থক্য দূর করার আহ্বান জানান। তিনি যোগ করেন, ‘চীন এই প্রচেষ্টায় সমর্থন যোগাতে প্রস্তুত।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়লে চীনের স্বার্থহানি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, চীন জ্বালানির জন্য এই অঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল এবং তারা এখানে একটি প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে চাইছে। উদাহরণস্বরূপ, সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
তবে বর্তমান সংঘাত নিরসনে চীনের ভূমিকা কী হতে পারে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। এমনকি তেহরানের ওপর চীনের কতটুকু প্রভাব রয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতারা চীন, ইরান, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে একটি জোট গঠনের বিষয়ে সতর্ক করেছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, ইরান থেকে তেল আমদানির ক্ষেত্রে চীন এখনো সবচেয়ে বড় ক্রেতা। যদিও তারা ২০২২ সাল থেকে ইরানের কাছ থেকে তেল কেনার বিষয়ে কোনো সরকারি তথ্য প্রকাশ করেনি। এ বছর যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তেল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে চীনের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এছাড়া, ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিক উপাদানও সম্প্রতি চীন থেকে ইরানে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের এই দীর্ঘদিনের সংঘাতের সমাধানে শেষ পর্যন্ত সেখানকার দেশগুলো এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী যুক্তরাষ্ট্রই প্রধান ভূমিকা নেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও সম্প্রতি এক টুইট বার্তায় জানিয়েছিলেন, ইরান ও ইসরাইল একটি চুক্তিতে আসবে এবং এ বিষয়ে ‘অনেক আলোচনা ও বৈঠক’ চলছে। তবে তিনি বিস্তারিত কিছু জানাননি। ট্রাম্প আরও বলেছেন, তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গেও এই পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন এবং শান্তি আলোচনায় তাঁকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত।
তথ্য সূত্র: সিএনএন