চীনের আদালতে মৃত্যুদণ্ড, কোটি টাকার জালিয়াতি সাম্রাজ্যের হোতারা!

শিরোনাম: মায়ানমারের সীমান্ত থেকে চীনে পাচার হওয়া কোটি কোটি টাকার প্রতারণা চক্রের হোতাদের মৃত্যুদণ্ড।

চীনের একটি আদালত মায়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকায় বিশাল এক অনলাইন প্রতারণা চক্রের মূল হোতাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। এই চক্রটি অনলাইন জালিয়াতি, জুয়া এবং মানব পাচারের মাধ্যমে কোটি কোটি ডলার হাতিয়ে নিয়েছিল।

সোমবার চীনের পূর্বাঞ্চলীয় ঝেজিয়াং প্রদেশের ওয়েনঝো ইন্টারমিডিয়েট পিপলস কোর্ট এই রায় ঘোষণা করে। এই চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ১১ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, এই অপরাধ চক্রটি “মিং পরিবার” নামে পরিচিত ছিল। তারা মায়ানমারের উত্তরাঞ্চলে সক্রিয় চারটি কুখ্যাত পরিবারের মধ্যে অন্যতম।

এই পরিবারগুলো মূলত ইন্টারনেট জালিয়াতি, পতিতাবৃত্তি এবং মাদক ব্যবসার মতো অবৈধ কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত। মিং পরিবারের সদস্যরা মায়ানমারের স্থানীয় সরকার ও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলত।

মিং পরিবারের প্রধান ছিলেন মিং শুয়েচ্যাং। এই পরিবারের সদস্যরা কোকাং অঞ্চলের “ক্রাউচিং টাইগার ভিলা” নামক একটি কুখ্যাত স্থানে তাদের কার্যক্রম চালাত।

একসময় তাদের অধীনে ১০,০০০ এর বেশি লোক কাজ করত, যারা বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার সঙ্গে জড়িত ছিল। কোকাংয়ের রাজধানী লাওকাইং ছিল এই বিশাল প্রতারণা ব্যবসার কেন্দ্র।

সেখানে পাচার হওয়া শ্রমিকদের ব্যবহার করে অনলাইন স্কিমের মাধ্যমে বিদেশীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হতো।

চীনের জন্য সীমান্ত অঞ্চলের এই অপরাধ একটি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে এবং প্রতারণার শিকার হওয়া অনেক মানুষের পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে, চীন ২০২৩ সালে এই চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে।

নভেম্বরে মিং পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে জালিয়াতি, হত্যা ও মানব পাচারের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয় এবং তাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ১৪,০০০ থেকে ৭০,০০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত পুরস্কার ঘোষণা করা হয়।

গ্রেফতারের সময় মিং শুয়েচ্যাং আত্মহত্যা করেন। তার ছেলে মিং কুওপিং, যিনি মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, মেয়ে মিং জিউলান এবং নাতনী মিং ঝেনঝেনকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।

চীনের আদালতের তথ্য অনুযায়ী, এই চক্রের সদস্যরা তাদের অপরাধের শিকার হওয়া এবং পালাতে চাওয়া ১০ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করেছে।

২০২৩ সালের অক্টোবরে, এই চক্রের সদস্যরা একটি প্রতারণা কেন্দ্রে অভিযান চালানোর সময় চারজন শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করে। চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম সিসিটিভি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশ অভিযানের খবর পেয়ে তারা শ্রমিকদের সরানোর চেষ্টা করছিল, সেই সময় এই ঘটনা ঘটে।

এছাড়াও, আরও পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড স্থগিত এবং ১২ জনকে ৫ থেকে ২৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আদালত জানিয়েছে, ২০১৫ সাল থেকে মিং পরিবার কোকাং অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করে এই প্রতারণা চক্র গড়ে তোলে।

তারা বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর কাছ থেকে সুরক্ষা নিয়েছিল। এই চক্র টেলিযোগাযোগ জালিয়াতি, ক্যাসিনো, মাদক পাচার এবং পতিতাবৃত্তির মতো অবৈধ ব্যবসা চালাত।

যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের অর্থায়নে পরিচালিত ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অফ পিসের তথ্যমতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতারণা চক্রগুলো প্রতি বছর প্রায় ৪৩ বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪ লক্ষ ৭৪ হাজার কোটি টাকা) হাতিয়ে নেয়।

মায়ানমারে দুর্নীতি ও অরাজকতার কারণে এই ধরনের প্রতারণা চক্রগুলো দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় ছিল। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটির অভ্যন্তরীণ সংঘাতের সুযোগ নিয়ে তারা তাদের ব্যবসার পরিধি আরও বাড়িয়েছে।

চীনের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে মায়ানমারের সরকারের কাছে সীমান্ত অপরাধ দমনের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল। এমনকি বিদ্রোহীরাও এই প্রতারণা চক্রগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সামরিক অভিযান শুরু করে।

বর্তমানে, চীন সরকার মায়ানমারের বিভিন্ন প্রতারণা কেন্দ্র থেকে ৫৩,০০০ এর বেশি সন্দেহভাজনকে (যাদের মধ্যে প্রতারণার শিকার হওয়া ব্যক্তিরাও রয়েছে) চীনে ফেরত পাঠিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাইবার জালিয়াতির এই জগৎ দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। অপরাধীরা ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করছে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের প্রতারণার কৌশল আরও উন্নত করছে।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *