চীনের সঙ্গে আমেরিকার চলমান দ্বন্দ্বে বেইজিং একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সুবিধা দেখছে: দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। চীনের নেতারা সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন, যেখানে দেশের পরবর্তী পাঁচ বছরের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ত্বরান্বিত করা থেকে শুরু করে খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা আধুনিকীকরণ— সবকিছুই এই পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত।
এই কৌশল নির্ধারণের পেছনে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একদিকে, চীন চাইছে আমদানি করা উচ্চ প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা কমাতে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করতে চাইছে।
তবে এই পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে চীনের নেতারা তাদের সক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ পাচ্ছেন। তারা দেখাতে চাইছেন, কীভাবে চীন সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য তৈরি করতে এবং তা বাস্তবায়নে সফল হতে পারে।
চীনের সরকারি গণমাধ্যম এবং কর্মকর্তাদের বক্তব্যে এই বিষয়গুলো বেশ স্পষ্ট। কমিউনিস্ট পার্টির নীতি গবেষণা অফিসের এক কর্মকর্তা জানান, পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি ও তা কার্যকর করা চীনের সমাজতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সুবিধা।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মধ্যে কৌশলগতভাবে এগিয়ে থাকতে এই ধরনের পরিকল্পনা অপরিহার্য।
চীনের সরকারি মুখপত্র ‘পিপলস ডেইলি’-র এক নিবন্ধে চীনের এই দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করা হয়। এতে বলা হয়, চীন “পুরো দেশকে একটি খেলার মাঠের মতো দেখে এবং সঠিক পথে অবিচলভাবে এগিয়ে চলে”, যেখানে “কিছু দেশ বহু-দলীয় ব্যবস্থার কারণে স্বল্পমেয়াদী চিন্তা করে এবং তাদের নীতিতে পরিবর্তন আনে।”
চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ‘সিনহুয়া’-র অন্য একটি নিবন্ধে চীনের এই ধারাবাহিকতা এবং নমনীয়তাকে পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য একটি কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
এই নিবন্ধে, চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষে চীনের মতো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা কঠিন।
অন্যদিকে, বেইজিং ডেইলি-র একটি নিবন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিকে ‘নিয়ন্ত্রণহীন’ হিসেবে তুলে ধরা হয়। সেখানে বিভিন্ন প্রতিবাদের পাশাপাশি সরকার পরিচালনায় অচলাবস্থা এবং বিতর্কিত কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়।
নিবন্ধটিতে উপসংহারে বলা হয়, “যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতি ক্ষণস্থায়ী এবং এর ভিত্তি দুর্বল। ট্রাম্পের ভাষায় বলতে গেলে, যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিক থেকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে এবং ভেতর থেকে ক্ষয় হচ্ছে।”
অবশ্য, চীনের কঠোর নিয়ন্ত্রণাধীন প্রচার মাধ্যমের জন্য এমন মন্তব্য নতুন কিছু নয়। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক দর্শকদের কাছে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে, তারা প্রায়ই অন্যান্য দেশের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতাগুলো তুলে ধরে।
তবে, এই ধরনের মন্তব্য চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির চিন্তাভাবনারই প্রতিফলন। বিশেষ করে যখন প্রযুক্তি এবং বাণিজ্য নিয়ে দুই দেশের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে, তখন এই ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণের সুযোগ আসে।
আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের আগে এবং চীনের বিরল খনিজ রপ্তানি নীতি সম্প্রসারণের প্রেক্ষাপটে, এই পরিকল্পনা প্রণয়ন চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
পরবর্তী পাঁচ বছরের পরিকল্পনার বিস্তারিত তথ্য আগামী মার্চ মাসে চীনের আইনসভায় অনুমোদনের পরেই প্রকাশ করা হবে।
তবে, ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির একটি শক্তিশালী কমিটির বৈঠকে গৃহীত অগ্রাধিকারগুলোর দিকে তাকালে চীনের ভবিষ্যৎ অগ্রগতির বিষয়ে আত্মবিশ্বাসের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
সরকারি সংবাদ মাধ্যম অনুসারে, এই পরিকল্পনায় ২০৩৫ সালের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক শক্তি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সক্ষমতা, জাতীয় প্রতিরক্ষা এবং আন্তর্জাতিক প্রভাব বিস্তারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
কর্মকর্তাদের মতে, তারা উৎপাদন, পণ্যের গুণমান, মহাকাশ গবেষণা, পরিবহন এবং সাইবার স্পেসের উন্নয়নে গতি আনবেন।
নেতারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি শিল্প খাতে উচ্চ প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
কোয়ান্টাম প্রযুক্তি, জৈব প্রযুক্তি, হাইড্রোজেন শক্তি, পারমাণবিক ফিউশন, ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস, এবং ষষ্ঠ প্রজন্মের মোবাইল যোগাযোগের মতো বিষয়গুলোকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন চালিকাশক্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বৈঠকের পর, চীনের ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিফর্ম কমিশনের প্রধান সাংবাদিকদের বলেন, চীন একটি শক্তিশালী উৎপাদন ও শিল্প শক্তি হিসেবে তার অবস্থান ধরে রাখতে চাইছে।
যদিও কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, উন্নত দেশগুলোর মতো চীনেরও পরিষেবা-নির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তর হওয়া উচিত।
এই পরিকল্পনায় জাতীয় নিরাপত্তা এবং সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
কর্মকর্তারা অভ্যন্তরীণ চাহিদা হ্রাস, আর্থ-সামাজিক বৈষম্য এবং অতিরিক্ত প্রতিযোগিতার মতো চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার কথা বলেছেন।
এছাড়াও, তারা ভোগের মাত্রা বৃদ্ধি এবং সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য চীনের দরজা আরও উন্মুক্ত করার কথা জানিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে চীনের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য অর্জনের ক্ষমতার কথা উল্লেখ করেছেন। দেশটি কয়েক কোটি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিয়েছে, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের নীতির কারণে দেশটির অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন আসায়, বেইজিং এখন চীনের পরিকল্পনাকে একটি দায়িত্বশীল বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছে।
চীনের একটি সরকারি সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, “বর্তমান বিশ্বে, কিছু প্রধান শক্তি প্রায়ই তাদের নীতি পরিবর্তন করে, যা বিশ্ব শান্তি ও উন্নয়নে শঙ্কার সৃষ্টি করে।”
সম্পাদকীয়তে আরও বলা হয়, চীনের আগামী পাঁচ বছরের পরিকল্পনা বিশ্বকে স্থিতিশীলতার একটি বিরল নিশ্চয়তা দেবে।
চীনের এই পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষমতাকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তার একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সুবিধা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
তথ্য সূত্র: সিএনএন।