চীনের হাতে ‘গুরুত্বপূর্ণ তাস’: বাণিজ্য যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিরল খনিজ অস্ত্রের ব্যবহার।
চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধ নতুন মোড় নিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতির মোকাবিলায় চীন এবার বিরল খনিজ পদার্থের ওপর নির্ভরশীলতা কাজে লাগাচ্ছে। এই খনিজ পদার্থগুলো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে।
বিরল মৃত্তিকা ধাতু (Rare Earth Metals) নামে পরিচিত ১৭টি মৌলিক পদার্থের একটি দল রয়েছে, যা আধুনিক প্রযুক্তির জন্য অপরিহার্য। স্মার্টফোন থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক গাড়ি, এমনকি সামরিক সরঞ্জাম—সবকিছুতেই এর ব্যবহার রয়েছে। এই উপাদানগুলো শুধু চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাওয়া যায়। তবে স্বল্প খরচে ও নিরাপদে এগুলো প্রক্রিয়াকরণ করা কঠিন।
চীন এই বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছে। আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা (International Energy Agency) এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে উৎপাদিত বিরল মৃত্তিকা ধাতুর ৬১ শতাংশই আসে চীন থেকে। প্রক্রিয়াকরণের দিক থেকেও চীন ৯২ শতাংশ বাজারের নিয়ন্ত্রণ করে।
২০১৯ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং একটি কারখানায় যান এবং কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘বিরল মৃত্তিকা ধাতু একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সম্পদ’। এরপর থেকেই এই খনিজ পদার্থের গুরুত্ব আরো বাড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধের অংশ হিসেবে চীন ৭ ধরনের বিরল মৃত্তিকা খনিজ পদার্থের রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে কোম্পানিগুলোকে এখন এই খনিজ পদার্থ এবং চুম্বকসহ সংশ্লিষ্ট পণ্য রপ্তানির জন্য সরকারের অনুমতি নিতে হচ্ছে। এই পদক্ষেপের ফলে আমেরিকার শিল্পখাতে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে।
বিরল মৃত্তিকা ধাতু দিয়ে তৈরি চুম্বক ছোট এবং শক্তিশালী মোটর ও জেনারেটর তৈরি করতে কাজে লাগে, যা স্মার্টফোন, গাড়ির ইঞ্জিন এবং জেট ইঞ্জিনসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া, এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ও পারমাণবিক সাবমেরিনের মতো অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জামের জন্যও এগুলো অপরিহার্য।
মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জাস্টিন উলফার্স বলেন, ‘চীন কৌশলগতভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থানে থেকে আমেরিকার শিল্পকে আঘাত করতে সক্ষম হচ্ছে।’
যুক্তরাষ্ট্রও এখন নিজস্ব সরবরাহ ব্যবস্থা তৈরির চেষ্টা করছে। বেশ কয়েকটি মার্কিন কোম্পানি উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াচ্ছে এবং মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে কাজ করছে। তবে এই প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ।
চীন রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় এরই মধ্যে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। অন্তত পাঁচটি মার্কিন ও ইউরোপীয় কোম্পানির বিরল মৃত্তিকা চুম্বকের চালান আটকে গেছে। কোম্পানিগুলো রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় লাইসেন্স পেতে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বিস্তারিত জানতে চাইছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের এই পদক্ষেপের ফলে বিশ্ববাজারে বিকল্পের অভাব দেখা দিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগ ইতিমধ্যে অভ্যন্তরীণ সরবরাহ ব্যবস্থা তৈরির জন্য ৪৩৯ মিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ বিনিয়োগ করেছে। ২০২৭ সালের মধ্যে তারা সামরিক চাহিদার জন্য প্রয়োজনীয় সরবরাহ ব্যবস্থা তৈরি করতে চায়।
কিছু মার্কিন কোম্পানি চীনের এই পদক্ষেপকে সুযোগ হিসেবে দেখছে। তারা উৎপাদন বাড়াতে এবং চীনের বাইরে শক্তিশালী সরবরাহ ব্যবস্থা তৈরি করতে চাইছে। একটি কোম্পানি জানিয়েছে, তারা বর্জ্য ও দূষণমুক্ত উপায়ে বিরল মৃত্তিকা ধাতু প্রক্রিয়াকরণের প্রযুক্তি তৈরি করেছে।
বর্তমানে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রয়োজনীয় বিরল মৃত্তিকা ধাতুর ৭০ শতাংশের জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীল।
চীন এর আগেও বিরল মৃত্তিকা ধাতু নিয়ে এমন পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০১০ সালে একটি আঞ্চলিক বিরোধের জেরে দেশটি জাপানে এই ধাতুর সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের এই পদক্ষেপগুলো বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে।
যুক্তরাষ্ট্র এখন এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছে। তাদের লক্ষ্য হলো, চীনের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
তথ্য সূত্র: সিএনএন