উচ্চ কোলেস্টেরল: হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে যা জানা জরুরি।
হৃদরোগ বর্তমানে একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। আমাদের দেশেও এর প্রকোপ বাড়ছে, যার অন্যতম প্রধান কারণ হলো উচ্চ কোলেস্টেরল। অনেক ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ ছাড়াই এই সমস্যা শরীরে বাসা বাঁধে। তাই, স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্তকরণ খুবই জরুরি। এই আর্টিকেলে আমরা কোলেস্টেরল, এর স্বাস্থ্য ঝুঁকি, এবং তা নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, যা বিশেষভাবে বাংলাদেশের মানুষের জন্য উপযোগী।
কোলেস্টেরল কি?
কোলেস্টেরল হলো এক ধরনের চর্বি জাতীয় পদার্থ, যা আমাদের শরীরে স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হয়। এটি কোষ তৈরি এবং হরমোন উৎপাদনে সাহায্য করে। তবে, এর মাত্রা বেড়ে গেলে তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
কোলেস্টেরলের প্রকারভেদ:
- এলডিএল (LDL): একে খারাপ কোলেস্টেরল বলা হয়। এর অতিরিক্ত মাত্রা ধমনীতে জমা হয়ে রক্ত চলাচলে বাধা দেয়, যা হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
- এইচডিএল (HDL): এটি ভালো কোলেস্টেরল হিসেবে পরিচিত। এইচডিএল, এলডিএল-কে সরিয়ে দিতে সাহায্য করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
ট্রাইগ্লিসারাইড:
রক্তে অতিরিক্ত ক্যালোরি থাকলে তা ট্রাইগ্লিসারাইডে পরিণত হয়। উচ্চ ট্রাইগ্লিসারাইডও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
কোলেস্টেরল পরীক্ষা কখন করাবেন?
চিকিৎসকরা সাধারণত ৪০ বছর বা তার বেশি বয়সীদের প্রতি ৫ বছর অন্তর কোলেস্টেরল পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেন। যাদের হৃদরোগের পারিবারিক ইতিহাস আছে বা বুকে ব্যথার মতো সমস্যা হয়, তাদের দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও স্থানীয় ক্লিনিকে এই পরীক্ষা করানো যায়।
পরীক্ষার ফলাফল:
রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে আপনার এলডিএল, এইচডিএল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা জানা যায়। এইচডিএল–এর স্বাভাবিক মাত্রা পুরুষের ক্ষেত্রে ১.০ mmol/L–এর বেশি এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ১.২ mmol/L–এর বেশি হওয়া উচিত। এলডিএল-এর মাত্রা ৩ mmol/L-এর নিচে থাকা ভালো। এছাড়া, কোলেস্টেরল অনুপাতও দেখা হয়, যা মোট কোলেস্টেরলকে এইচডিএল দিয়ে ভাগ করে পাওয়া যায়। এটি ৬-এর নিচে থাকা স্বাস্থ্যকর।
উচ্চ কোলেস্টেরলের কারণ:
- অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: অতিরিক্ত ফ্যাট ও চিনিযুক্ত খাবার গ্রহণ কোলেস্টেরল বাড়ায়।
- শারীরিক কার্যকলাপের অভাব: নিয়মিত ব্যায়াম না করলে এলডিএল বাড়ে।
- ধূমপান ও মদ্যপান: এগুলোও কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়াতে পারে।
- জিনগত প্রভাব: কারো কারো ক্ষেত্রে বংশগত কারণেও কোলেস্টেরল বেশি হতে পারে।
কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে ডায়েট ও লাইফস্টাইল পরিবর্তন:
- স্বাস্থ্যকর খাবার: খাদ্যতালিকায় আঁশযুক্ত খাবার, ফল, সবজি, ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ মাছ, বাদাম এবং বীজ যোগ করুন।
- ফ্যাট নিয়ন্ত্রণ: স্যাচুরেটেড ফ্যাট (মাখন, ঘি, ফাস্ট ফুড) এবং ট্রান্স ফ্যাট (বেকারি পণ্য) পরিহার করুন। রান্নার জন্য অলিভ অয়েল, রাইস ব্রান অয়েল, বা ক্যানোলা তেল ব্যবহার করুন।
- নিয়মিত ব্যায়াম: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিটের জন্য হাঁটা, দৌড়ানো বা অন্যান্য শারীরিক কার্যকলাপ করুন।
- ওজন নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত ওজন কমাতে চেষ্টা করুন।
- ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করুন।
ওজন কমাতে ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়ক কিছু খাবার:
- ওটস: ওটসে বিটা-গ্লুকান নামক দ্রবণীয় ফাইবার থাকে, যা কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে।
- ডাল ও শিম: এগুলো উচ্চ ফাইবারযুক্ত এবং কম ফ্যাটযুক্ত প্রোটিনের ভালো উৎস।
- ফল ও সবজি: প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত ফল ও সবজি যোগ করুন।
কোলেস্টেরল কমাতে ঔষধ:
যদি লাইফস্টাইল পরিবর্তনের পরেও কোলেস্টেরল না কমে, তাহলে ডাক্তার স্ট্যাটিন জাতীয় ওষুধ দিতে পারেন। স্ট্যাটিন, লিভারে কোলেস্টেরল তৈরি হওয়া কমায়।
উপসংহার:
উচ্চ কোলেস্টেরল হৃদরোগের একটি নীরব ঘাতক। তাই, এর ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো জরুরি। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, এবং প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করে আমরা আমাদের হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে পারি।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান