নগরায়ণ ও মানসিক স্বাস্থ্য: বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে শহর পরিকল্পনা।
আমাদের সমাজে, বিশেষ করে শহরে, মানুষজন ক্রমশ একাকী হয়ে পড়ছে। আধুনিক জীবনযাত্রার চাপ, কর্মব্যস্ততা এবং উন্নত জীবনের আকাঙ্ক্ষা মানুষকে তার আপনজন ও সমাজের থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।
সম্প্রতি, নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিজ্ঞানীরা বলছেন, শহরের নকশা তৈরি করার মাধ্যমে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করা সম্ভব।
কিভাবে? আসুন, বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা বলছে, দেশটির প্রায় অর্ধেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ একাকিত্বে ভোগেন।
যা দিনে ১৫টা সিগারেট খাওয়ার মতই ক্ষতিকর! এই পরিস্থিতিতে, মানুষ কীভাবে তাদের চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে মিশে আরও ভালো থাকতে পারে, সেই বিষয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে।
শহরের রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে বাসস্থান, এমনকি পরিবহন ব্যবস্থা— সবকিছুই মানুষের পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করার জন্য শহরের নকশা তৈরির কিছু বিশেষ দিক রয়েছে।
যেমন, জনগণের জন্য উন্মুক্ত স্থান তৈরি করা, যেখানে মানুষজন মিলিত হতে পারে।
ইতালির “পিয়াজ্জা” এর একটি দারুণ উদাহরণ।
এই ধরনের স্থানে রেস্টুরেন্ট, দোকান ও সবুজ প্রকৃতির সমাবেশ থাকে, যা মানুষকে আকর্ষণ করে এবং তাদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করে।
এছাড়াও, আবাসিক এলাকার নকশাতেও পরিবর্তন আনা যায়।
রান্না ও আড্ডার জন্য সাধারণ স্থান তৈরি করা যেতে পারে, যেখানে বাসিন্দারা একসঙ্গে সময় কাটাতে পারে।
সিঁড়িগুলোকে এমনভাবে ডিজাইন করা যায়, যা মানুষের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের সুযোগ তৈরি করে।
জানালায় বড় কাঁচ ব্যবহার করার ফলে বাইরের দৃশ্য যেমন দেখা যায়, তেমনি সামাজিক মিথস্ক্রিয়াও বাড়ে।
কানাডার একটি পরামর্শক সংস্থা, “হ্যাপি সিটিজ”, শহরগুলোতে এই ধরনের পরিবর্তনের জন্য কাজ করছে।
তাদের মতে, আবাসনের অভাব, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সামাজিক একাকীত্ব—এই সমস্যাগুলো সমাধানে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
তারা মনে করেন, বহুতল ভবনের বদলে এমন আবাসন তৈরি করা উচিত, যা মানুষের মধ্যে সম্পর্ক বাড়াতে সাহায্য করে।
উদাহরণস্বরূপ, ভ্যাঙ্কুভারের “আওয়ার আর্বান ভিলেজ”-এর কথা বলা যায়।
এখানে ১২টি পরিবারের জন্য একটি যৌথ আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে।
এই ধরনের আবাসনে বাসিন্দাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয় এবং একাকিত্বের অনুভূতি কমে আসে।
গবেষণায় দেখা গেছে, এখানে বসবাসকারীরা অন্যদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক উপভোগ করেন।
তবে, এই ধারণাগুলো বাস্তবায়িত করা সহজ নয়।
কারণ, শহর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অনেক পক্ষের মধ্যে আলোচনা ও সমঝোতা প্রয়োজন হয়।
স্থানীয় সরকার, ডেভেলপার এবং স্থানীয় জনগণের স্বার্থের বিষয়টিও এখানে জড়িত থাকে।
তবুও, কিছু শহর এই ধারণাগুলো গ্রহণ করতে শুরু করেছে।
নিউইয়র্ক সিটি তাদের নকশা নীতিমালায় এমন কিছু বিষয় যুক্ত করেছে, যা মানুষের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক বাড়াতে সহায়তা করে।
বার্সেলোনা একাকিত্ব কমাতে একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যেখানে শহরের স্থানগুলোকে কমিউনিটি স্পেসে রূপান্তরিত করার কথা বলা হয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল শহরেও “সিউল উইদাউট লোনলিনেস” নামে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
যেখানে সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
সবশেষে, আমরা বলতে পারি, শহরের নকশা পরিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো করা সম্ভব।
এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া, তবে এর ফলস্বরূপ একটি সুস্থ ও সুখী সমাজ তৈরি করা যেতে পারে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক