ডিগ্রী-খরচ বনাম লাভ: শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন সমীকরণ!

উচ্চ শিক্ষার ভবিষ্যৎ: আমেরিকার অভিজ্ঞতা ও বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিকতা

শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে উন্নত বিশ্বে প্রায়ই নতুন নতুন আলোচনা হয়, যেখানে ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ এবং তাদের বিনিয়োগের মূল্য কতটুকু, তা নিয়ে নতুন করে ভাবা হয়। সম্প্রতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কলেজ শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।

একদিকে যেমন বাড়ছে টিউশন ফি, তেমনি বাড়ছে ছাত্র ঋণ, এবং চাকরির বাজারও কঠিন হয়ে উঠছে। এমন পরিস্থিতিতে, কলেজ ডিগ্রি কতটা লাভজনক, সেই হিসাব কষতে শুরু করেছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা।

যুক্তরাষ্ট্রের কলেজগুলো এখন ‘রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট’ বা বিনিয়োগের প্রতিদান (ROI)-এর ধারণাটিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তারা দেখাচ্ছে, একটি ডিগ্রি অর্জনের পর শিক্ষার্থীরা কত দ্রুত ভালো চাকরি পায় এবং তাদের উপার্জনের পরিমাণ কেমন হয়।

কিছু র‍্যাংকিংয়েও এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কলোরাডোর মতো কিছু রাজ্যে কলেজ ডিগ্রির আর্থিক সুবিধা নিয়ে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হচ্ছে, এমনকি টেক্সাসও সরকারি অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে এই বিষয়টির ওপর নজর রাখছে।

আমেরিকার ‘আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট’-এর গবেষক প্রেসটন কুপার মনে করেন, “শিক্ষার্থীরা এখন বুঝতে পারছে যে সবসময় একটি কলেজ ডিগ্রি লাভজনক নাও হতে পারে। আগে যেখানে বিষয়টি এতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এটি নিয়ে ভাবছে।”

গবেষণা বলছে, সাধারণভাবে, স্নাতক ডিগ্রি এখনো লাভজনক। তবে, সব ডিগ্রি যে ভালো বেতনে চাকরি এনে দেয়, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রে, ভালো ফল পাওয়া গেলেও, চাকরির বাজারের কারণে সেই সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে।

সম্প্রতি ‘স্ট্রাডা এডুকেশন ফাউন্ডেশন’-এর এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আমেরিকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য স্নাতক হওয়া ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী ১০ বছরের মধ্যে ইতিবাচক ফল আশা করতে পারে। অর্থাৎ, তাদের আয়, হাই স্কুল পাশ করা একজন সাধারণ ব্যক্তির চেয়ে বেশি হবে।

তবে, এই হার অঙ্গরাজ্য ভেদে ভিন্ন। যেমন, নর্থ ডাকোটায় এই হার ৫৩ শতাংশ, অন্যদিকে ওয়াশিংটন ডিসিতে ৮২ শতাংশ। যে রাজ্যগুলোতে শিক্ষার খরচ তুলনামূলকভাবে কম, সেখানে ফল ভালো।

যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি কতটা প্রাসঙ্গিক? আমাদের দেশেও কি উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে বিনিয়োগের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে? অভিভাবকদের মধ্যে কি এমন ধারণা তৈরি হচ্ছে যে, একটি ভালো বেতনের চাকরি পাওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট ডিগ্রি অপরিহার্য নয়?

ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ফারজানা আহমেদ বলেন, “আমি মনে করি, এখন শুধু একটি ভালো ডিগ্রি থাকলেই চলে না, বরং সেই ডিগ্রির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক দক্ষতাও থাকতে হয়। কারণ, বাজারে এখন দক্ষ কর্মীর চাহিদা বেশি।”

অন্যদিকে, অনেক শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষা বা বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণে ঝুঁকছে। তারা মনে করছে, দ্রুত চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে এই ধরনের শিক্ষা বেশি সহায়ক হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষামন্ত্রীও চার বছর মেয়াদী ডিগ্রির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি এমন কিছু প্রোগ্রামের প্রশংসা করেছেন, যা শিক্ষার্থীদের দ্রুত কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত করে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে: টিউশন ফি কমানো এবং স্নাতকদের ভালো চাকরি নিশ্চিত করা। জন্মহার কমে যাওয়ায় কলেজগুলো এখন ছাত্রছাত্রী পাওয়ার জন্য তীব্র প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বাড়ানোর দিকেও জোর দেওয়া হচ্ছে। মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট কেভিন গাস্কিভিচ জানিয়েছেন, তারা এখন এমন প্রোগ্রাম তৈরি করছেন, যা বাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

তবে, একটি বড় সমস্যা হলো, ডিগ্রি অর্জনের পরও অনেক গ্র্যাজুয়েট তাদের শিক্ষা অনুযায়ী কাজ পায় না। ‘বার্নিং গ্লাস ইনস্টিটিউট’-এর এক গবেষণা বলছে, আমেরিকার প্রায় ৫২ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট এমন কাজ করছেন, যার জন্য তাদের ডিগ্রির প্রয়োজন নেই। এমনকি শিক্ষা এবং নার্সিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা ঘটছে।

মার্কিন সরকারও এই সমস্যা সমাধানে কাজ করছে। কলেজ প্রোগ্রামগুলোকে, যাদের গ্র্যাজুয়েটরা কম আয় করে, তাদের জন্য ফেডারেল ফান্ড কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে, স্বচ্ছতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিক্ষার্থীদের জানার সুযোগ তৈরি করা হচ্ছে যে, কোন প্রোগ্রাম থেকে পাশ করে ভালো চাকরি পাওয়া যায়। এর জন্য কলেজ স্কোরকার্ডের মতো ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়েছে, যেখানে বিভিন্ন প্রোগ্রামের ফলাফল সম্পর্কে তথ্য দেওয়া হয়।

উচ্চ শিক্ষার এই সংকট, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, আমাদেরও এই বিষয়গুলো নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য কোন ধরনের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সবচেয়ে উপযোগী, এবং কীভাবে তাদের ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত করা যায়, সেই বিষয়ে নতুন নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন।

তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস (AP)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *