মহাকাশে আসছে প্রথম বাণিজ্যিক স্টেশন! কেমন হবে?

মহাকাশ গবেষণা এবং প্রযুক্তির জগতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন হতে চলেছে। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (International Space Station – ISS)-এর মেয়াদ ফুরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই, বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক মহাকাশ স্টেশন “হ্যাভেন-১” (Haven-1) -এর উৎক্ষেপণের প্রস্তুতি চলছে।

ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ভাস্ট স্পেস (Vast Space), স্পেসএক্স (SpaceX)-এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ২০২৬ সালের মে মাসে এই স্টেশনটি উৎক্ষেপণ করার পরিকল্পনা করছে।

প্রায় ২৫ বছর ধরে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (আইএসএস) পৃথিবীর কক্ষপথে অবিরাম কাজ করে চলেছে। ২৬টি দেশের প্রায় ৩০০ জন নভোচারীর পদচিহ্ন পড়েছে এই স্টেশনে, যা আন্তর্জাতিক সহযোগিতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

কিন্তু এর কার্যকারিতা ধীরে ধীরে কমছে, তাই নাসা (NASA) ২০৩০ সালের দিকে এটিকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে। এই শূন্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে আসছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা।

নাসা চাইছে বাণিজ্যিক মহাকাশ স্টেশনের ধারণাটিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে, যেখানে তারা এই স্টেশনগুলির পরিষেবা কিনবে।

হ্যাভেন-১, মূলত একটি একক মডিউল বিশিষ্ট স্টেশন। এর ডিজাইন করা হয়েছে মানুষের জীবনযাত্রার কথা মাথায় রেখে। ৪.৪ মিটার (প্রায় ১৪.৭ ফুট) ব্যাসের এই স্টেশনের অভ্যন্তরে থাকবে ৪৫ ঘনমিটার (প্রায় ১,৫০০ ঘনফুট) জায়গা, যা একটি সাধারণ ডাবল ডেকার বাসের আকারের প্রায় আট ভাগের এক ভাগ।

এটিতে থাকবে একটি বিজ্ঞানাগার, যেখানে ক্ষুদ্র-মাধ্যাকর্ষণ (microgravity) পরিবেশে গবেষণা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সুযোগ থাকবে। সেমিকন্ডাক্টর সহ বিভিন্ন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি তৈরিরও সম্ভাবনা রয়েছে এখানে।

ভাস্ট স্পেস-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ম্যাক্স হ্যাট (Max Haot) জানিয়েছেন, তাঁদের মূল লক্ষ্য হল একটি কার্যকরী মহাকাশ স্টেশন তৈরি করা, যেখানে মানুষ বসবাস করতে পারবে এবং নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারবে।

হ্যাভেন-১-এর নকশার মধ্যে রয়েছে একটি ১.২ মিটার (৪ ফুট) আকারের গম্বুজাকৃতির জানালা, একটি ভাঁজ করা যায় এমন টেবিল, প্রতিটি ক্রু সদস্যের জন্য আলাদা ঘুমের জায়গা এবং স্টারলিঙ্ক (Starlink)-এর মাধ্যমে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ।

“এটি বিলাসবহুল হোটেলের মতো নয়,” বলেছেন হ্যাট, “তবে আমরা বিশ্বাস করি, ভালো পরিবেশে থাকলে, বিশ্রাম ভালো হলে এবং যোগাযোগ সহজ হলে, কাজও ভালো হয়।”

ম্যাক্স হ্যাট

এই প্রকল্পের ঘোষণার পর থেকে, ভাস্ট স্পেস-এর কর্মী সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে তাদের প্রায় ৯৫০ জন কর্মী রয়েছেন। সংস্থাটি হ্যাভেন-১ মডিউল তৈরির পাশাপাশি, বৃহত্তর হ্যাভেন-২ নির্মাণেরও পরিকল্পনা করছে, যা আইএসএস-এর উত্তরসূরি হতে পারে।

এই প্রকল্পের জন্য ভাস্ট প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে, যা তাদের প্রতিষ্ঠাতা জেদ ম্যাকক্যালেবের ব্যক্তিগত পুঁজি এবং গ্রাহকদের কাছ থেকে আসা রাজস্বের সমন্বয়ে গঠিত।

হ্যাভেন-১ উৎক্ষেপণের আগে, এর প্রযুক্তিগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করা হবে। এরপর নভোচারীদের একটি দল এই স্টেশনে যাবে, যারা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নে কাজ করবেন।

ভাস্ট স্পেস-এর লক্ষ্য হল, মহাকাশ গবেষণা এবং অনুসন্ধানে আগ্রহী উদীয়মান দেশগুলোকে তাদের প্রথম নভোচারী পাঠানোর সুযোগ দেওয়া। সেই সঙ্গে, ব্যক্তিগত উদ্যোগে মহাকাশে যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জন্যও সুযোগ রাখা হবে।

হ্যাভেন-১-এ বিভিন্ন বাণিজ্যিক গবেষণা এবং উন্নয়নের সুযোগ থাকবে। ফ্লোরিডা ভিত্তিক মহাকাশ অবকাঠামো কোম্পানি রেডওয়্যার স্পেস (Redwire Space) এই স্টেশনে তাদের গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

রেডওয়্যার-এর কর্পোরেট উন্নয়ন বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট, রিচ বোলিং (Rich Boling) জানিয়েছেন, তাঁরা মূলত ওষুধ তৈরি এবং ক্যান্সার শনাক্তকরণ সহ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করবেন।

তবে, বাণিজ্যিক মহাকাশ স্টেশন তৈরি এবং পরিচালনা করা বেশ ব্যয়বহুল। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির (Massachusetts Institute of Technology – MIT) বিশেষজ্ঞ অলিভার দে উইক (Olivier de Weck) জানিয়েছেন, আইএসএস-এর দৈনিক পরিচালন খরচ প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ ডলার, যার অর্ধেকই লাগে নভোচারী ও মালামাল পরিবহনে।

বাণিজ্যিক মহাকাশ স্টেশনগুলিকে কার্যকরী হতে হলে বছরে ১ থেকে ২ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে পরিচালন খরচ সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।

মহাকাশ প্রযুক্তির এই অগ্রযাত্রায় নাসা একা কাজ করছে না। অন্যান্য অনেক বেসরকারি সংস্থাও এই দৌড়ে শামিল হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে স্টারল্যাব, যা এয়ারবাস (Airbus) এবং নর্থরপ গ্রুম্যান (Northrop Grumman)-এর একটি যৌথ উদ্যোগ।

এছাড়াও, জেফ বেজোসের ব্লু অরিজিন (Blue Origin) এবং টেক্সাস-ভিত্তিক অ্যাক্সিয়ম স্পেস (Axiom Space) উল্লেখযোগ্য।

ভিয়েনা ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির স্থপতি ও মহাকাশ গবেষক সান্দ্রা হাউপলিক-মেসবুর্গার (Sandra Häuplik-Meusburger) মনে করেন, ছোট আকারের একটি মডিউল দিয়ে শুরু করা একটি ভালো কৌশল।

কারণ এতে জটিলতা কম থাকে এবং খরচও হয়। তবে, ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে পরিকল্পনা করতে হবে।

মরগান স্টেট ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য ও নগর নকশার অধ্যাপক ফ্রেডেরিক স্কারমেন (Frederick Scharmen) হ্যাভেন-১ প্রকল্পের প্রশংসা করেছেন, কারণ এটি নভোচারীদের আরাম এবং প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিচ্ছে।

এই বাণিজ্যিক মহাকাশ স্টেশনগুলি মহাকাশ গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে এবং ভবিষ্যতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, যা বাংলাদেশের জন্যও সুযোগ তৈরি করতে পারে।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *