কোভিড-১৯ অতিমারীর সূত্রপাত নিয়ে এখনো বিশ্বজুড়ে বিতর্ক চলছে। ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল নিয়ে বিভিন্ন তত্ত্ব প্রচলিত থাকলেও, বিজ্ঞানীদের একটি বড় অংশ মনে করেন, এর উৎস ছিল প্রাণীদেহ থেকে মানুষে সংক্রমণ (zoonotic origin)।
অন্যদিকে, অনেকে মনে করেন, এটি কোনো গবেষণাগার থেকে ছড়িয়েছে (lab leak)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র তত্ত্বাবধানে গঠিত একটি বিশেষজ্ঞ দল (SAGO) সম্প্রতি তাদের মূল্যায়নে জানিয়েছে, কোভিড-১৯ সম্ভবত প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়েই ছড়িয়েছে। কিন্তু এই বিতর্কের মাঝে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্বের উত্থান, বিজ্ঞান ও জনস্বাস্থ্যের প্রতি মানুষের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে, যা ভবিষ্যতে মহামারী প্রতিরোধের প্রস্তুতিকে দুর্বল করে তুলছে।
ভাইরাসটি কিভাবে এলো, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ২০১৯ সালের শেষ দিকে চীনের উহান শহরে প্রথম এই ভাইরাস শনাক্ত হয়।
এরপর থেকেই বিজ্ঞানীরা এর উৎপত্তিস্থল অনুসন্ধানে বিভিন্ন গবেষণা চালাচ্ছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভাইরাসটি সম্ভবত উহানের একটি বাজারের বন্য প্রাণী থেকে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।
এই তত্ত্বের সমর্থনে প্রমাণ হিসেবে, উহানের হুয়ানান বাজারের আশেপাশে আক্রান্তদের প্রাথমিক সংক্রমণ এবং সেখানকার পরিবেশ থেকে সংগৃহীত নমুনায় ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে, অনেকে মনে করেন, ভাইরাসটি কোনো গবেষণাগার থেকে ছড়িয়েছে। তবে, এই ধারণার স্বপক্ষে তেমন কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
SAGO-র রিপোর্টেও এই তত্ত্বের পক্ষে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ মেলেনি। বরং, তথ্যের অভাবে অনেক সময় এই ধরনের তত্ত্ব জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করে এবং বিজ্ঞানীদের গবেষণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
কোভিড-১৯ অতিমারীর সময় দেখা গেছে, গুজব ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুল তথ্য পরিবেশিত হওয়ায় অনেকে বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মকর্তাদের প্রতি আস্থা হারিয়েছেন।
এর ফলে টিকা গ্রহণে অনীহা দেখা দেয়, যা ভাইরাসটিকে আরও বেশি ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারের ফলে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবিষ্যতের মহামারী প্রতিরোধের জন্য বিজ্ঞানসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এর জন্য প্রয়োজন গবেষণায় পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
কোভিড-১৯ অতিমারী আমাদের শিখিয়েছে, একটি শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং বিজ্ঞানভিত্তিক পদক্ষেপের গুরুত্ব।
বাংলাদেশেও কোভিড-১৯ এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। তাই, ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত থাকতে হলে, বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে পদক্ষেপ নিতে হবে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি, টিকাদান কর্মসূচি জোরদার করা এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
কোভিড-১৯ এর উৎপত্তিস্থল নিয়ে বিতর্ক চলতেই থাকবে, তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, গুজব ও ষড়যন্ত্র তত্ত্বের পরিবর্তে বিজ্ঞানসম্মত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
ভবিষ্যতের মহামারী মোকাবিলায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য।
তথ্য সূত্র: CNN