শারীরিক সক্ষমতা বাড়াতে এবং পেশী গঠনে সহায়ক একটি জনপ্রিয় খাদ্য পরিপূরক হলো ক্রিয়েটিন। ক্রীড়াবিদ থেকে শুরু করে শরীরচর্চা করেন এমন অনেকের কাছেই এই উপাদানটি সুপরিচিত। সম্প্রতি এর উপকারিতা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আলোচনা চলছে।
আজকের প্রতিবেদনে আমরা ক্রিয়েটিন কী, এর কার্যকারিতা, স্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং কাদের জন্য এটি বেশি উপযোগী, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানব।
ক্রিয়েটিন মূলত একটি যৌগ যা আমাদের শরীরে স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হয়। এটি লিভার, কিডনি এবং অগ্ন্যাশয়ে উৎপাদিত হয়। এছাড়াও, মাছ, মাংস এবং ডিমের মতো প্রাণীজ প্রোটিনেও ক্রিয়েটিন পাওয়া যায়।
ক্রিয়েটিন পেশী কোষের জন্য দ্রুত শক্তি সরবরাহ করে। এটি ‘এ টি পি’ (অ্যাডেনোসিন ট্রাইফসফেট) পুনরুৎপাদনে সাহায্য করে, যা কোষের শক্তি উৎপাদনের মূল উৎস।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ক্রিয়েটিন আমাদের শরীরের তিনটি প্রধান শক্তি ব্যবস্থার একটিতে সাহায্য করে, যা স্বল্পমেয়াদী এবং উচ্চ তীব্রতার ব্যায়ামের সময় প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে। যেমন—স্প্রিন্টিং বা ওজন তোলার মতো ব্যায়ামে ক্রিয়েটিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তবে দীর্ঘ সময় ধরে চলা ম্যারাথনের মতো ব্যায়ামের জন্য এর তেমন কোনো প্রভাব নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্রিয়েটিন গ্রহণ করলে পেশী আরও ভালোভাবে কাজ করতে পারে। নিয়মিত শরীরচর্চা করেন এমন ব্যক্তিরা ক্রিয়েটিন সেবনের মাধ্যমে তাদের ব্যায়ামের সময়সীমা সামান্য বাড়াতে পারেন এবং একই ওজনের সঙ্গে আরও বেশি পুনরাবৃত্তি করতে সক্ষম হতে পারেন।
সাধারণ স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ক্রিয়েটিন সাপ্লিমেন্টের প্রয়োজন হয় না, কারণ শরীর তার প্রয়োজনীয় ক্রিয়েটিন তৈরি করতে পারে। তবে যারা নিয়মিত শরীরচর্চা করেন, তারা তাদের ওয়ার্কআউটের ফল আরো ভালো করার জন্য এটি গ্রহণ করেন।
বাজারে ক্রিয়েটিন বিভিন্ন ফর্মে পাওয়া যায়, তবে ক্রিয়েটিন মনোহাইড্রেইট সবচেয়ে বেশি গবেষণিত এবং কার্যকরী। এটি সাধারণত সাদা, স্বাদহীন পাউডার আকারে পাওয়া যায় এবং তুলনামূলকভাবে সস্তা।
একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত লক্ষ্য অনুসারে এর ডোজ ভিন্ন হতে পারে, তবে দৈনিক ৫ গ্রাম ক্রিয়েটিনের খরচ খুব বেশি নয়।
ক্রিয়েটিন সেবন স্বাস্থ্যকর প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হয়। দীর্ঘদিন ধরে এটি ব্যবহার করা যেতে পারে এবং এটি নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে।
যদিও, কিছু ক্ষেত্রে ক্রিয়েটিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে, যেমন—পেট ফাঁপা বা সামান্য পেট ব্যথা। বেশি পরিমাণে ক্রিয়েটিন গ্রহণ করলে এই সমস্যাগুলো আরও বাড়তে পারে।
তাই, কিডনি সম্পর্কিত কোনো সমস্যা থাকলে ক্রিয়েটিন ব্যবহারের আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
ক্রিয়েটিন কি সত্যিই পেশী গঠনে সাহায্য করে? সরাসরি উত্তর হলো, যতটা প্রচার করা হয়, ততটা নয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ক্রিয়েটিন ব্যবহার করেছেন এবং যারা করেননি, তাদের মধ্যে পেশী আকারে খুব বেশি পার্থক্য দেখা যায়নি।
উভয় দলই গড়ে প্রায় ২ কেজি করে পেশী লাভ করেছে। ক্রিয়েটিন মূলত পেশীতে জল জমা করে, যা সাময়িকভাবে শরীরের ওজন বাড়াতে পারে এবং পেশীকে আরও পূর্ণ দেখায়।
দীর্ঘমেয়াদে ক্রিয়েটিনের পেশী বৃদ্ধিতে কিছুটা প্রভাব থাকতে পারে, তবে তা তাৎক্ষণিক নয়।
ক্রিয়েটিন কাদের জন্য বেশি উপকারী? সাধারণত, ক্রীড়াবিদদের মধ্যে যারা শারীরিক সক্ষমতা বাড়াতে চান, তাদের জন্য ক্রিয়েটিন সহায়ক হতে পারে। এছাড়া, বয়স্ক ব্যক্তি, বিশেষ করে মেনোপজের পর পেশী দুর্বল হয়ে যাওয়া নারীদের জন্য এটি উপকারী হতে পারে।
এটি প্রতিরোধের প্রশিক্ষণ এবং ওয়ার্কআউটের পরে পেশী পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে। নিরামিষভোজী বা যারা পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রাণীজ প্রোটিন গ্রহণ করেন না, তাদের জন্যও ক্রিয়েটিন উপকারী হতে পারে।
তবে, কিছু মানুষের ক্ষেত্রে ক্রিয়েটিনের তেমন কোনো প্রভাব নাও দেখা যেতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ক্রিয়েটিনের প্রভাব নিয়েও গবেষণা চলছে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, ক্রিয়েটিন মস্তিষ্কের শক্তি বাড়িয়ে, স্মৃতিশক্তি উন্নত করে এবং মনোযোগ বাড়াতে সহায়ক হতে পারে।
এটি সেরোটোনিন ও ডোপামিন উৎপাদনে সাহায্য করে, যা মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়ক। বিষণ্ণতা রোগীদের চিকিৎসায় ক্রিয়েটিন একটি সহায়ক উপাদান হিসেবে কাজ করতে পারে।
তবে বাইপোলার ডিসঅর্ডারের রোগীদের ক্ষেত্রে এটি ব্যবহারের আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
তরুণদের জন্য ক্রিয়েটিন ব্যবহারের বিষয়ে কিছু সতর্কতা রয়েছে। চিকিৎসকরা সাধারণত ১৮ বছরের কম বয়সীদের জন্য ক্রিয়েটিন ব্যবহারের সুপারিশ করেন না, কারণ এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব এখনো অজানা।
অল্পবয়সীদের মধ্যে ক্রিয়েটিনের ব্যবহার শরীরচর্চার প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ এবং শারীরিক গঠন নিয়ে উদ্বেগের কারণ হতে পারে।
পরিশেষে, ক্রিয়েটিন ব্যবহারের আগে অবশ্যই একজন ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। এটি আপনার শরীরের জন্য উপযুক্ত কিনা, সে বিষয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান