মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে শব্দজট বা ক্রসওয়ার্ড পাজলের ভূমিকা নিয়ে অনেকেরই আগ্রহ রয়েছে। বয়স্কদের স্মৃতিশক্তি প্রখর রাখতে এই ধরনের খেলা সহায়ক—এমন ধারণা প্রচলিত।
কিন্তু সত্যিই কি শব্দজট মস্তিষ্কের জন্য উপকারী? সম্প্রতি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আসুন, বিশেষজ্ঞদের মতামত ও গবেষণার আলোকে বিষয়টির গভীরে যাওয়া যাক।
শব্দজট বা সুডোকুর মতো খেলাগুলো মস্তিষ্কের জন্য এক প্রকার ব্যায়াম হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত। অনেকে মনে করেন, এগুলো মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক। ২০২০ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কের প্রশিক্ষণে এবং জ্ঞানীয় (cognitive) উপকারিতার জন্য এই ধরনের পাজলগুলি খুবই জনপ্রিয়।
কিন্তু এই ধারণা এলো কোথা থেকে? সম্ভবত, এর কারণ হলো— যারা নিয়মিত শব্দজট সমাধান করেন, তাদের অনেকের মধ্যে মানসিক সতেজতা দেখা যায়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই দুটির মধ্যে সম্পর্ক আসলে আমরা যা ভাবি, তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যারা শব্দজট সমাধান করতে পছন্দ করেন, তাদের হয়তো ভালো শব্দজ্ঞান বা ভাষাগত দক্ষতা রয়েছে। আর উচ্চ শিক্ষা ও ভালো শব্দজ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে স্মৃতিভ্রংশতা বা ডিমেনশিয়া (dementia) হওয়ার ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম থাকে।
তবে শব্দজট মস্তিষ্কের জন্য কতটা উপকারী, সেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, শব্দজট মস্তিষ্কের নিউরাল সার্কিটকে সক্রিয় করে এবং মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়ায়। তবে এর জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত চ্যালেঞ্জিং শব্দজট।
অর্থাৎ, শব্দজটটি কঠিন হতে হবে, আবার খুব বেশি কঠিন হলেও চলবে না। শারীরিক স্বাস্থ্যের মতো মস্তিষ্কের ক্ষেত্রেও ‘ব্যবহার না করলে ক্ষয়’ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
নিয়মিত শব্দজট সমাধান মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, শব্দজট খেলা জ্ঞানীয় উন্নতিতে সাহায্য করতে পারে।
২০২২ সালের একটি গবেষণায় জানা যায়, যাদের স্মৃতিভ্রংশতার (mild cognitive impairment – MCI) প্রাথমিক লক্ষণ দেখা গেছে, তাদের ক্ষেত্রে ১২ সপ্তাহ ধরে শব্দজট খেলার ফলে জ্ঞানীয় উন্নতি হয়েছে। যদিও এই উন্নতি খুব সামান্য ছিল।
২০২৪ সালের আরেকটি গবেষণায় শব্দজট এবং মস্তিষ্কের ভালো স্বাস্থ্যের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গেছে। এই গবেষণায় ৯,০০০ এর বেশি মানুষের জীবনযাত্রা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বোর্ড গেম ও শব্দজট খেলার মতো অভ্যাসগুলি ভালো যুক্তি তৈরি ও স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সহায়ক।
তবে শব্দজট খেলার উপকারিতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। শব্দজট এবং মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের মধ্যে সম্পর্ক আসলে কার্যকারণ সম্পর্ক (causation) নাও হতে পারে।
শব্দজট কিছু ক্ষেত্রে সহায়ক হলেও, মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে জীবনযাত্রার অন্যান্য কিছু পরিবর্তনের (যেমন—নিয়মিত শরীরচর্চা) ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়।
তাহলে মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে আর কী কী করা যেতে পারে? চিকিৎসকরা বলছেন, নিয়মিত শরীরচর্চা এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি আলঝেইমার রোগ (Alzheimer’s disease) এবং জ্ঞানীয় দুর্বলতার ঝুঁকি কমাতে সহায়ক।
শরীরচর্চা মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসের (hippocampus) আয়তন বাড়াতে সাহায্য করে, যা শেখা ও স্মৃতির জন্য অপরিহার্য। এছাড়া, এটি মস্তিষ্কের নতুন সংযোগ তৈরি করতে এবং স্বাস্থ্যকর জ্ঞানীয় কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন তৈরিতেও সাহায্য করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কার্ডিও ব্যায়াম জ্ঞানীয় কার্যাবলী বাড়াতে সহায়ক। বয়স্ক ব্যক্তিরা যারা নিয়মিত শরীরচর্চা করেন, তাদের জ্ঞানীয় ক্ষমতা অন্যদের থেকে ভালো থাকে।
শুধু ব্যায়ামই নয়, ডিমেনশিয়া প্রতিরোধের জন্য জীবনযাত্রার আরও কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন। যেমন—শ্রবণশক্তি হ্রাস, মস্তিষ্কে আঘাত, উচ্চ রক্তচাপ, অতিরিক্ত মদ্যপান, অতিরিক্ত ওজন, ধূমপান, বিষণ্ণতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, শারীরিক निष्क्रियতা, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, বায়ু দূষণ, উচ্চ কোলেস্টেরল, চোখের সমস্যা এবং শৈশবে কম শিক্ষা—এগুলোও ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
তাহলে কেন মনে করা হয়, শব্দজট সমাধানকারীরা বয়স্ককালে বেশি সজাগ থাকেন? সম্ভবত, শব্দজট সমাধানকারীরা অন্যান্য স্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলোও মেনে চলেন। তারা সাধারণত বেশি শিক্ষিত হন এবং সামাজিক জীবন বজায় রাখেন, যা ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমাতে সহায়ক।
শব্দজট খেলার মাধ্যমে মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখা যায়। মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বজায় রাখতে এটি সহায়ক হতে পারে। তবে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমাতে হলে, শব্দজটের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা এবং নিয়মিত শরীরচর্চা করা অপরিহার্য।
সুতরাং, শব্দজট খেলা খারাপ কিছু নয়। এটি মানসিক উদ্দীপনা যোগায়। তবে মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হলে একটি সামগ্রিক পদ্ধতির (multi-pronged approach) প্রয়োজন। এতে শরীরচর্চা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং সামাজিক জীবন বজায় রাখার মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক