ডানিয়ুব ব-দ্বীপ: প্রকৃতির এক অপরূপ লীলাভূমি।
ইউরোপের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত রুমানিয়ার ডানিয়ুব ব-দ্বীপ, প্রকৃতির এক অসাধারণ সৃষ্টি। এটি শুধু একটি ব-দ্বীপ নয়, বরং জীববৈচিত্র্যের এক বিশাল ভাণ্ডার।
ইউনেস্কো-র স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এই অঞ্চলে রয়েছে পাখির এক বিশাল আবাসস্থল, সেই সঙ্গে এখানকার লিয়েতা বনভূমি একে দিয়েছে এক ভিন্ন মাত্রা।
ডানিয়ুব নদী কৃষ্ণ সাগরে পতিত হওয়ার আগে অসংখ্য শাখানদীতে বিভক্ত হয়ে এই ব-দ্বীপের সৃষ্টি করেছে।
ব-দ্বীপটির রুমানীয় অংশে প্রবেশ করলে দেখা যায় সবুজ বনভূমি আর জলাভূমির এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। এখানে প্রায় ৩০০ প্রজাতির পাখির বসবাস, যাদের মধ্যে পেলিকান, হুইস্কার্ড টার্ন এবং হোয়াইট-টেইলড ঈগল অন্যতম।
পাখিপ্রেমীদের জন্য এটি যেন এক স্বর্গরাজ্য।
লিয়েতা বনভূমি ব-দ্বীপ অঞ্চলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানগুলোর মধ্যে একটি। রুমানিয়ার প্রাচীনতম সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম, যা ১৯৩৮ সাল থেকে সংরক্ষিত।
এই বনের বিশেষত্ব হলো এর ভৌগোলিক অবস্থান। এটি ইউরোপের সবচেয়ে উত্তরের উপ-ক্রান্তীয় বনভূমি, যা বিভিন্ন বিরল প্রজাতির উদ্ভিদের আবাসস্থল। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, কৃষ্ণ সাগর এবং ডানিয়ুব নদী থেকে আসা বীজ ও পাখির মাধ্যমে এই বনের সৃষ্টি হয়েছে।
লিয়েতা গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা ড্যানিয়েল পেত্রেস্কু, যিনি ব-দ্বীপ অঞ্চলের একজন অভিজ্ঞ গাইড। তিনি জানান, বনের বালুকাময় ভূমি প্রায় ১৪,০০০ থেকে ১১,০০০ বছর আগে গঠিত হয়েছিল, তবে লিয়েতা বনের সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ৫০০ বছর আগে।
এই বন এখনো মানুষের তেমন ছোঁয়া পায়নি, যা একে আরও বিশেষ করে তুলেছে।
ড্যানিয়েলের মতে, ব-দ্বীপের বিশালতা ও বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দৃশ্য এর অন্যতম আকর্ষণ।
ব-দ্বীপের ছোট ছোট খাল ধরে নৌকায় ভ্রমণ করার সময় নতুন কিছু আবিষ্কার করা যায়। বনের কাছাকাছি গেলে দেখা যায় অবাধে ঘুরে বেড়ানো কিছু বন্য ঘোড়া, যা এই অঞ্চলের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তোলে।
তবে এরা মূলত এক ধরণের বুনো ঘোড়া, যাদের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে পরিবেশের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লিয়েতা বনে প্রবেশ করলে অন্য এক জগৎ-এ যেন প্রবেশ করা যায়।
পুরনো ওক, সাদা পপলার এবং অ্যাশ গাছের চারপাশে লতানো গাছপালা, যেমন সিল্ক ভাইন ও ‘ওল্ড ম্যান’স বিয়ার্ড-এর মতো নানান উদ্ভিদ দেখা যায়।
বনের ভেতরের সরু পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ড্যানিয়েল মাঝে মাঝে বিরল প্রজাতির অর্কিড-এর কথা বলেন, যা এই বনের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তোলে।
বন পেরিয়ে গেলে দেখা যায় বালুকাময় টিলার সারি, যা দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত।
এখানকার একটি ঐতিহ্য হলো ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে ভ্রমণ করা। এরপর পর্যটকেরা লিয়েতা গ্রামে প্রবেশ করে।
গ্রামের রাস্তার দু’পাশে দেখা যায় পুরনো দিনের খড়ের চালের ঘর, যা আজও সেই অঞ্চলের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।
আশির দশকে রুমানিয়ায় কমিউনিজম-এর পতনের পর অনেক গ্রামবাসী কাজের খোঁজে অন্য শহরে পাড়ি জমিয়েছিল।
বর্তমানে পর্যটন এখানকার মানুষের জীবিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
লিয়েতা গ্রামের এক বাড়িতে স্থানীয় রাঁধুনি ভিয়োরিকা ম্যাক্সিম-এর রান্না করা ঐতিহ্যবাহী খাবার, যেমন মাছের স্যুপ, ক্যাটাফিস এবং স্থানীয়ভাবে তৈরি করা মিষ্টি খাবার পরিবেশন করা হয়।
ড্যানিয়েল বলেন, “এই ব-দ্বীপ আমার শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত, কিন্তু এখানকার প্রকৃতির গুরুত্ব আমি এখন বুঝি।” ব-দ্বীপের সৌন্দর্য শুধু এর প্রকৃতির মাঝে নয়, বরং এখানকার মানুষের জীবনযাত্রার মধ্যেও বিদ্যমান।
প্রকৃতির প্রতি সচেতনতা বাড়ার সাথে সাথে এই অঞ্চলের গুরুত্ব আরও বেশি উপলব্ধি করা যায়।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক