গোপন জঙ্গলে অভিবাসন: হঠাৎ বন্ধ, কান্নায় ভাঙা জীবন!

ড্যারিয়েন গ্যাপ: এক সময়ের সোনার খনি, আজ যেনো এক অচেনা জনপদ

পানামার দুর্গম ড্যারিয়েন গ্যাপ অঞ্চলে, কলম্বিয়া সীমান্তের কাছে, একসময় অভিবাসন কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এক জমজমাট অর্থনীতি। জীবন ধারণের জন্য কঠিন পথ পাড়ি দেওয়া মানুষের আনাগোনায় স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনে এসেছিল সমৃদ্ধি।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতিতে পরিবর্তনের ফলে সেই ‘সোনার খনি’ আজ যেনো বন্ধ হয়ে গেছে, যার ফলে সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রা এক নতুন সংকটের মুখে পড়েছে।

২০২১ সালের দিকে, জীবন ও জীবিকার সন্ধানে আসা মানুষের ঢল নামে ড্যারিয়েন গ্যাপে। অর্থনৈতিক সংকট, যুদ্ধ এবং নিপীড়ন থেকে বাঁচতে উত্তর আমেরিকার দিকে যাত্রা করা মানুষের কাছে এই অঞ্চলটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ।

এই অভিবাসন প্রবাহকে কেন্দ্র করে স্থানীয়রা বিভিন্ন ব্যবসা শুরু করে, যেমন – নৌকায় করে মানুষ পারাপার, খাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ ইত্যাদি।

ভিলা কালেটা’র বাসিন্দা লুইস ওলেয়া, যিনি একসময় অভিবাসন প্রত্যাশীদের পারাপারের জন্য নৌকা চালাতেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি ছবি তার টিভিতে দেখিয়ে বলেন, “আগে আমরা অভিবাসন থেকে রোজগার করতাম।

কিন্তু এখন সব শেষ।” ওলেয়ার মত অনেকেই একসময় জঙ্গল পরিষ্কার করে ধান ও অন্যান্য শস্য উৎপাদন করতেন, কিন্তু অভিবাসীদের আগমনের ফলে তারা এই কাজ ছেড়ে দিয়ে নৌকার ব্যবসা শুরু করেন।

এই ব্যবসার মাধ্যমে তারা প্রতিদিন ৩০০ ডলার পর্যন্ত আয় করতেন, যা তাদের আগের আয়ের থেকে অনেক বেশি ছিল। ওলেয়া তার বাড়িতে সৌর প্যানেল স্থাপন করেন, টিভি কেনেন এবং একটি আধুনিক জীবন শুরু করেন।

কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর অভিবাসন নীতির কারণে পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যায়। সীমান্ত পারাপার প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, স্থানীয় অর্থনীতিতে ধস নামে।

এই অঞ্চলের আরেক বাসিন্দা, চোলিনো দে গ্রাসিয়া জানান, “সবচেয়ে খারাপ দিক হল, এখন অনেক মানুষের খাবার জোটে না। কোনো আয় নেই, আবার এখানে বাজারও নেই, তাই তারা কিনবে কী?”

আরেকজন, পেদ্রো চামি, যিনি একসময় নৌকা চালাতেন, এখন সোনার খোঁজে নদীর বালু খুঁড়ছেন। তিনি বলেন, “আগে প্রতিদিন ২০০ ডলার রোজগার করতাম, কিন্তু এখন একটি টাকাও নেই।”

ড্যারিয়েন গ্যাপের কাছাকাছি লাজাস ব্ল্যাঙ্কাস বন্দর একসময় ছিল অভিবাসীদের পদচারণায় মুখরিত। সেখানে খাবার, সিম কার্ড, কম্বল এবং মোবাইল চার্জ করার দোকান বসতো।

কিন্তু এখন সেটি প্রায় জনশূন্য। জবেয়িদা কনসেপসিওন নামে এক নারী জানান, অভিবাসন কমে যাওয়ায় অনেকেই এলাকা ছেড়ে পানামা শহরে চলে গেছে।

কনসেপসিওন এর পরিবার একসময় অভিবাসীদের জন্য খাবার ও পানীয় বিক্রি করত। তাদের উপার্জিত অর্থে তিনি নতুন বিছানা, ওয়াশিং মেশিন, ফ্রিজ কিনেছেন এবং বাড়ি তৈরি শুরু করেছেন।

এখন তিনি জানেন না কী করবেন, তবে কিছু সঞ্চয় করেছেন এবং ভবিষ্যতের জন্য ফ্রিজগুলো রেখে দিয়েছেন।

পানামার কর্মকর্তারা জানান, একসময় যেখানে প্রতিদিন ২,৫০০ থেকে ৩,০০০ মানুষ ড্যারিয়েন গ্যাপ পাড়ি দিত, সেখানে এখন সপ্তাহে মাত্র ১০ জন যায়।

এখন আবার অনেক অভিবাসী, বিশেষ করে ভেনেজুয়েলার নাগরিকরা, পানামার ক্যারিবিয়ান উপকূল ধরে তাদের দেশে ফিরতে শুরু করেছে।

এই পরিস্থিতিতে, অপরাধী গোষ্ঠীগুলো নতুন উপায়ের সন্ধান করছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক এলিজাবেথ ডিকিনসন বলেন, “যারা একসময় অভিবাসন থেকে লাভবান হয়েছিল, তারা এখন বিপরীতমুখী অভিবাসন থেকে মুনাফা করার চেষ্টা করছে।”

ড্যারিয়েন গ্যাপের এই গল্পটি শুধু একটি অঞ্চলের মানুষের জীবন পরিবর্তনের কাহিনী নয়, বরং এটি বিশ্ব অর্থনীতির এক জটিল চিত্রও তুলে ধরে। অভিবাসন নীতি, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং বৈশ্বিক ঘটনা কিভাবে স্থানীয় জনপদগুলোর জীবনকে প্রভাবিত করে, ড্যারিয়েন গ্যাপ যেন তারই এক জীবন্ত উদাহরণ।

তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *