যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন নীতির কড়াকড়িতে ওয়াশিংটন ডিসিতে শিশুদের স্কুলযাত্রা: উদ্বেগে অভিভাবকেরা।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে (Washington D.C.) শিশুদের স্কুল খোলার সময় অভিভাবকদের মধ্যে নতুন এক ধরনের উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। সেখানকার অভিবাসন নীতি কঠোর হওয়ায় এবং ফেডারেল কর্তৃপক্ষের ধরপাকড় বেড়ে যাওয়ায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
এর ফলে অভিবাসী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে ভয় ও শঙ্কা বাড়ছে।
শহরের একটি মধ্য-বিদ্যালয়ে, যেখানে অনেক শিক্ষার্থী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের, অভিভাবক ও শিক্ষকরা তাদের শিশুদের ইউনিয়ন স্টেশন (শহরের ব্যস্ততম রেলস্টেশন)-এ আনা-নেওয়ার জন্য অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করছেন। ন্যাশনাল গার্ডের সদস্যরাও সেখানে টহল দিচ্ছে।
অভিভাবকদের হাতে ছিল পরিচয়পত্র, যাতে তারা শিশুদের অভিভাবক বা তাদের সঙ্গে থাকা ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হন। স্কুলের প্রথম দিনে তাদের ‘অহেতুক ঘোরাঘুরি’ করতে নিষেধ করে পুলিশ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মা জানান, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হলেও শিশুদের সঙ্গে থাকার সময় সব সময় পাসপোর্ট সাথে রাখেন। তিনি বলেন, “আমার মেয়ে ও তার সহপাঠীদের রক্ষার জন্য ঝুঁকি নিতেও আমি প্রস্তুত, কিন্তু তাদের নিরাপত্তা দেওয়াটাও জরুরি।”
ওয়াশিংটনের স্কুলগুলোতে এখন অভিবাসন ও কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (ICE) কর্মকর্তাদের উপস্থিতি এবং আটকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্কুলগুলো বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। জানা গেছে, গত ৭ই আগস্ট থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে ডি.সি.-তে অভিবাসন সংক্রান্ত বিষয়ে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩০০ জনের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
অভিভাবকেরা এখন স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাইছেন, তাদের ‘আইসিই নীতি’ (ICE policy) কী? স্থানীয় একটি ভাষা শিক্ষা স্কুলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জেনিন পিয়াজেনজা জানান, সাধারণত তারা স্কুলের খাবার ও শিশুদের ঘুমের সময় নিয়ে প্রশ্ন করেন, তবে এবার অভিভাবকদের প্রধান প্রশ্ন ছিল, ‘আপনাদের আইসিই নীতি কী?’
এই উদ্বেগের কারণ শুধু অভিভাবকরাই নন, স্কুলের কর্মীরাও ভীত। পিয়াজেনজার মতে, তার স্কুলের ৯০ শতাংশ কর্মীই অভিবাসী এবং তাদের মধ্যে অনেকেই স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলেন।
তাদের মধ্যে অনেকেই গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে ভীত।
সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে, স্কুল কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের পাসপোর্ট সঙ্গে রাখতে বলেছে। এছাড়াও, আইসিই কর্মকর্তাদের কোনো অভিযানের শিকার হলে কী করতে হবে, সে বিষয়ে একটি প্রোটোকল তৈরি করা হয়েছে, যেখানে স্কুল নেতৃত্ব ও মেট্রোপলিটন পুলিশ বিভাগকে তাৎক্ষণিক যোগাযোগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের কর্মীদের বৈধ কাগজপত্র যাচাই করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। পিয়াজেনজা বলেন, “আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে, যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের পাসপোর্ট সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে হবে। আমি এমন একটি শহর দেখিনি, যেখানে কোনো দাঙ্গা ছাড়াই ন্যাশনাল গার্ড টহল দিচ্ছে।”
একজন শিক্ষক জানিয়েছেন, সব সময় নিজের ক্রস-বডি ব্যাগে পাসপোর্ট রাখলে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যায়। তিনি বলেন, “আমি যখন বাইরে যাই, এমনকি বাথরুমে গেলেও পাসপোর্ট সাথে রাখি।”
কার্লা মারেরো সান্তোস নামে আরেকজন অভিভাবক জানান, তিনি এখন বাইরে স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলতে ভয় পান। কারণ তিনি মনে করেন, স্প্যানিশ ভাষা ব্যবহারকারীদের টার্গেট করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, “আমি আমার ভাষায় কথা বলতে ভয় পাই, তাই নিরাপদ থাকার জন্য ইংরেজি বলি। বিশেষ করে যখন মেয়ের সঙ্গে বাইরে যাই। জীবনে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হব, তা কখনো ভাবিনি।”
সান্তোস মনে করেন, স্কুলে ইংরেজি ও স্প্যানিশ দুটো ভাষাই শেখানো উচিত, তবে তিনি স্কুলের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক অভিভাবক জানান, “যারা বৈধ কাগজপত্র দেখাচ্ছে, তারাও ভীত।” তার মতে, কর্তৃপক্ষ প্রথমে আটক করে, পরে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
এই পরিস্থিতিতে স্কুলগুলো তাদের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অতিরিক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। একটি ডি.সি. পাবলিক চার্টার স্কুল তাদের বার্ষিক বাজেট থেকে অর্থ খরচ করে শিক্ষার্থীদের মেট্রো স্টেশনে আনা-নেওয়ার জন্য একটি প্রাইভেট বাস ভাড়া করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন স্কুল প্রশাসক জানান, এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া তাদের জন্য কঠিন, কারণ এটি দীর্ঘমেয়াদে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
এই স্কুলটিতে মূলত ল্যাটিনো পরিবারের শিক্ষার্থীরা পড়ে। স্কুলটি নিরাপত্তা প্রোটোকল আরও জোরদার করেছে এবং ফেডারেল এজেন্ট এলে শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।
শিক্ষকদের এজেন্টদের জানাতে বলা হয়েছে যে, আদালতের পরোয়ানা ছাড়া তারা স্কুলে প্রবেশ করতে পারবে না।
স্কুল প্রশাসক আরও জানান, শিক্ষকরা স্কুলের আশেপাশে অবস্থান করেন, যাতে উদ্বিগ্ন শিক্ষার্থীদের সাহস যোগানো যায়। ডি.সি. পাবলিক স্কুল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে অভিভাবকদের জানানো হয়েছে, স্কুলের ভেতর কোনো ধরনের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভিযান চালানোর জন্য বৈধ পরোয়ানা বা আদালতের আদেশের প্রয়োজন হবে।
ডি.সি. স্কুল ডিস্ট্রিক্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে প্রায় ৫২,০০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী ইংরেজি ভাষার শিক্ষার্থী, যাদের বেশিরভাগই অভিবাসী পরিবার থেকে এসেছে বা বিদেশি।
উমবের্তো ভিলন নামের একজন অভিভাবক, যিনি তাঁর সন্তানদের কম্যুনি কিডস ও ডি.সি. পাবলিক স্কুলে পাঠান, ১৭ বছর ধরে পরিবারসহ এই শহরে বসবাস করছেন। তিনি বলেন, পরিস্থিতি এখন বেশ উদ্বেগজনক।
“কয়েক বছর আগেও এখানে একটি সুখী পরিবেশ ছিল, যেখানে পরিবার গড়ে তোলা যেত। আমরা চাই, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক।”
সান্তোস বলেন, সন্তানদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে এবং তাদের ভালো ভবিষ্যতের জন্য চেষ্টা করতে অভিভাবকদের অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, “রাস্তায় বের হলে সব সময় সতর্ক থাকতে হয়, সবকিছু নিরাপদ কিনা, সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়।”
তথ্য সূত্র: সিএনএন (CNN)