মানব বিবর্তন: বিজ্ঞানীরা ‘ড্রাগন মানব’-এর খুলি আবিষ্কার করলেন, যা ডেনিসোভানদের মুখ উন্মোচন করে
চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পাওয়া যাওয়া একটি বিশেষ খুলি, যা বিজ্ঞানীদের কাছে ‘ড্রাগন মানব’ নামে পরিচিত ছিল, সেটি আসলে এক সময়ের রহস্যময় মানব প্রজাতি ডেনিসোভানদের—এমনটাই মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
এই আবিষ্কার মানবজাতির ইতিহাস সম্পর্কে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। আগে এই প্রজাতি সম্পর্কে আমাদের ধারণা ছিল খুবই সীমিত, কারণ তাদের সম্পর্কে জানা ছিল কেবল সাইবেরিয়ার একটি গুহায় পাওয়া যাওয়া একটি আঙুলের হাড় থেকে।
২০২১ সালে, পাঁচ জন চীনা গবেষকের একটি দল বিতর্ক সৃষ্টি করেছিলেন, যখন তাঁরা ঘোষণা করেন যে চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পাওয়া যাওয়া একটি অস্বাভাবিক খুলি সম্ভবত আগে অজানা একটি প্রজাতির, যার নাম তাঁরা দিয়েছিলেন ‘হোমো লঙ্গি’। স্থানীয় লং জিয়াং ড্রাগন নদীর এলাকার নামের সাথে মিল রেখে এই নামকরণ করা হয়।
পরবর্তীতে বেইজিংয়ের ইনস্টিটিউট অফ ভার্টিব্রেট প্যালিওন্টোলজি অ্যান্ড প্যালিয়োঅ্যানথ্রোপলজির জীবাশ্মবিদ কিয়াওমেই ফু-এর সাথে গবেষকদের যোগাযোগ হয়।
ফু এই খুলি থেকে ডিএনএ (DNA) বের করার চেষ্টা করেন।
২০১০ সালে, ফু সাইবেরিয়ার ডেনিসোভা গুহায় পাওয়া একটি ছোট আঙুলের হাড় থেকে ডিএনএ বিশ্লেষণ করে সাড়া ফেলেছিলেন।
সেই বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, সেখানে ডেনিসোভান নামক এক মানবগোষ্ঠীর বসবাস ছিল, যাদের সম্পর্কে আগে বিজ্ঞানীদের কোনো ধারণা ছিল না এবং যাদের অন্য কোনো জীবাশ্মও (Fossil) পাওয়া যায়নি।
সম্প্রতি, ‘সায়েন্স’ (Science) এবং ‘সেল’ (Cell) জার্নালে প্রকাশিত দুটি গবেষণাপত্রে ফু এবং তাঁর দল উল্লেখ করেছেন যে, ‘ড্রাগন মানব’ সম্ভবত ডেনিসোভান প্রজাতিরই অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এই আবিষ্কার নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, কারণ এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ডেনিসোভানদের একটি সম্পূর্ণ খুলি পাওয়া গেল।
এই খুলিটিকে ‘হারবিন খুলি’ নামেও ডাকা হয়।
কিয়াওমেই ফু বলেন, “১৫ বছর পর আমরা ডেনিসোভানদের একটি মুখ দিতে পারলাম।
এটা সত্যিই এক বিশেষ অনুভূতি, আমি খুব আনন্দিত।”
গবেষণা থেকে জানা গেছে, ডেনিসোভানদের মুখ ছিল প্রশস্ত এবং নিচু ধরনের।
তাদের বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে ছিল – চোখের উপরের ভুরুর সুস্পষ্ট খাঁজ, সরু গালের হাড় এবং অপেক্ষাকৃত सपाট মুখ।
তাদের বিশাল শরীর সম্ভবত চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের তীব্র শীত থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করত।
এই আবিষ্কার প্রাচীন মানব প্রজাতি এবং তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে সাহায্য করবে।
টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবাশ্মবিজ্ঞানী বেন্স ভায়োলা বলেন, “এ ধরনের ভালোভাবে সংরক্ষিত খুলি আমাদের ডেনিসোভানদের বিভিন্ন অঞ্চলের জীবাশ্মের সাথে তুলনা করতে সাহায্য করবে।
এর মাধ্যমে আমরা তাদের শারীরিক গঠন এবং জলবায়ুর সাথে তাদের অভিযোজন সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারব।”
খুলি থেকে কিভাবে নিশ্চিত হলো?
খুলির ডিএনএ (DNA) পরীক্ষা করার পর, বিজ্ঞানীরা দাঁত এবং কানের ভেতরের হাড়ের (petrous bone) ডিএনএ (DNA) বিশ্লেষণের চেষ্টা করেন।
কিন্তু সেখানে কোনো জিনগত উপাদান পাওয়া যায়নি।
এরপর তাঁরা প্রোটিন বিশ্লেষণের আশ্রয় নেন।
প্রোটিন ডিএনএ-এর চেয়ে বেশি স্থিতিশীল এবং ডিএনএ-এর জিন দ্বারা তৈরি হওয়ায়, এটি ডিএনএ সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে।
৯৫টি ভিন্ন প্রোটিনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়, যার মধ্যে চারটি ডেনিসোভান এবং অন্যান্য হোমিনিনদের মধ্যে ভিন্নতা দেখায়।
এই চারটি প্রোটিনের মধ্যে তিনটিতে ডেনিসোভান বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেছে।
ডিএনএ (DNA) নিশ্চিত করার জন্য, বিজ্ঞানীরা অবশেষে একটিমাত্র দাঁতের প্লেক (dental plaque) পরীক্ষা করেন।
প্লেক খুবই স্থিতিশীল উপাদান হলেও, সাধারণত সেখানে ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ (DNA) পাওয়া যায়।
তবে, সব হিসাব উল্টে দিয়ে গবেষকরা সেখানে মানব ডিএনএ-এর একটি ক্ষুদ্র অংশ খুঁজে পান, যা খুলির ডিএনএ-এর সাথে মিলে যায়।
তবে, এই ডিএনএ (DNA) বিশ্লেষণের ফলাফল নিয়ে বিতর্কও রয়েছে।
এই গবেষণাপত্রের সহ-লেখক এবং একই ইনস্টিটিউটের গবেষক জিজুন নি-এর মতে, প্রোটিন বিশ্লেষণ যথেষ্ট সুনির্দিষ্ট নয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএ-এর মাধ্যমে প্রজাতি চিহ্নিত করা সম্ভব নয়।
গবেষণায় ফু উল্লেখ করেছেন যে, প্রাপ্ত ডিএনএ-এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সম্ভবত দূষণের ফল।
তবে, প্রাচীন ডিএনএ চিহ্নিত করার জন্য ব্যবহৃত পদ্ধতি অনুসরণ করে, বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, খুলিতে পাওয়া যাওয়া সামান্য ডিএনএ-ও ডেনিসোভানদের বৈশিষ্ট্য বহন করে।
ফু বলেন, “এতে ২৭টি জিনের ভিন্নতা রয়েছে, যা শুধুমাত্র পরিচিত ৭ জন ডেনিসোভান ব্যক্তির মধ্যেই পাওয়া যায়।
আধুনিক মানুষের দূষণের কারণে এর কোনোটির সৃষ্টি হয়নি।”
ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবাশ্মবিজ্ঞানী ফ্রিডো ওয়েলকার এই গবেষণা সম্পর্কে বলেন, “উপাত্তগুলো বেশ নির্ভরযোগ্য।
হারবিন খুলি সম্ভবত ডেনিসোভানদেরই।”
এই আবিষ্কারের ফলে বিজ্ঞানীরা এখন নিশ্চিত যে, ডেনিসোভানরা আগে যা ভাবা হতো, তার চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত অঞ্চলে বাস করত।
এই আবিষ্কারের পর একটি প্রশ্ন উঠেছে – যেহেতু ডেনিসোভানদের আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো একটি প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি, তাহলে কি এখন থেকে তাদের ‘হোমো লঙ্গি’ হিসেবে উল্লেখ করা হবে?
কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন, হ্যাঁ, তাই করা উচিত।
জিন নি বলেন, “যদি লেখকদের দাবি সত্য হয়, তাহলে ডেনিসোভানরা ‘হোমো লঙ্গি’ প্রজাতির একটি অংশ, যেমন নিউ ইয়র্কের বাসিন্দারা এবং বেইজিংয়ের বাসিন্দারা সবাই ‘হোমো সেপিয়েন্স’।”
লন্ডনের প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘরের জীবাশ্মবিজ্ঞানী ক্রিস স্ট্রিংগারও এই মতের সঙ্গে একমত।
তাঁর মতে, “এখন পর্যন্ত পাওয়া ডেনিসোভানদের মধ্যে হারবিন খুলি সবচেয়ে সম্পূর্ণ।
তাই এই গোষ্ঠীর জন্য ‘হোমো লঙ্গি’ প্রজাতি নামটিই উপযুক্ত।”
তবে, অন্যান্য বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই সময়ের হোমিনিনদের জন্য আলাদা প্রজাতির নাম ব্যবহার করাটা খুব একটা ফলপ্রসূ হবে না।
বিজ্ঞানী স্বান্তে প্যাবো বলেন, “আমরা নিয়ান্ডারথাল বা ডেনিসোভানদের জন্য প্রজাতির নাম ব্যবহার করি না।
কারণ তারা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত এবং তাদের মধ্যে প্রজনন সম্ভব।
যদি একটি প্রজাতির নাম প্রয়োজন হয়, তবে আমরা তাদের সবার জন্য ‘হোমো সেপিয়েন্স’ ব্যবহার করব।”
নামকরণ বিতর্ক সরিয়ে রাখলে, একটি বিষয় এখনো খুবই গুরুত্বপূর্ণ—আঙুলের হাড় থেকে যাদের সম্পর্কে জানা গিয়েছিল, সেই মানব প্রজাতি ডেনিসোভানদের এবার একটি মুখ পাওয়া গেছে।
শুধু তাই নয়, আমরা জানতে পেরেছি যে তারা কেবল সাইবেরিয়ায় নয়, পূর্ব এশিয়ার বিশাল অঞ্চলে বসবাস করত।
এই আবিষ্কার পূর্ব এশিয়ায় পাওয়া অন্যান্য রহস্যজনক জীবাশ্ম সম্পর্কে ধারণা দিতে সাহায্য করবে এবং বিজ্ঞানীদের নতুন করে গবেষণার জন্য উৎসাহিত করবে।
এছাড়াও, ডেনিসোভান এবং আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে আন্তঃপ্রজনন (interbreeding) সম্পর্কেও নতুন আলোকপাত করবে।
ডেনিসোভান ‘ড্রাগন মানব’-এর শেষ বংশধরের মৃত্যুর পরও, তাদের কিছু জিনগত উপাদান আজও আমাদের মধ্যে বিদ্যমান।
তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক