ডেনমার্কের খাদ্য বিপ্লব: একটি স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যতের দিশা?
বর্তমান বিশ্বে, স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার গুরুত্ব বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে বিভিন্ন রোগব্যাধি। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং ক্যানসারের মতো মারাত্মক রোগ প্রতিরোধের জন্য পুষ্টিকর খাবার অপরিহার্য।
আর এই ব্যাপারে ডেনমার্ক এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যেখানে খাদ্য তালিকায় শস্য জাতীয় খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়েছে।
ডেনমার্ক সরকার, স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্থা, খাদ্য প্রস্তুতকারক এবং খাদ্য সরবরাহকারী—এদের সমন্বয়ে গঠিত ‘ড্যানিশ হোল গ্রেইন পার্টনারশিপ’ নামক একটি উদ্যোগের মাধ্যমে এই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে।
২০০৮ সালে যখন এই প্রকল্পের সূচনা হয়, তখন একজন ডেনিশ নাগরিক প্রতিদিন গড়ে ৩৬ গ্রাম শস্য জাতীয় খাবার গ্রহণ করতেন।
কিন্তু এই প্রকল্পের সফলতায় ২০১৯ সাল নাগাদ এই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২ গ্রামে, যা ইউরোপের মধ্যে সর্বোচ্চ।
তাহলে, এই শস্য জাতীয় খাবারের গুরুত্ব ঠিক কী?
পুষ্টিবিদদের মতে, খাদ্য তালিকায় পূর্ণ শস্য যোগ করার ফলে হৃদরোগ, ক্যানসার, টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমে।
এছাড়াও, এটি শরীরের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে, রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা স্থিতিশীল করতে এবং অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়তা করে।
ডেনমার্কের এই সাফল্যের মূল কারণ হলো, তারা খাদ্য বিষয়ক নীতিমালায় পরিবর্তন এনেছে এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়িয়েছে।
এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল, খাদ্য তালিকায় শস্য জাতীয় খাবারের পরিমাণ বৃদ্ধি করা।
ডেনমার্কে নয় ধরনের শস্য জাতীয় শস্য খাদ্য হিসেবে পরিচিত: গম, স্পেল্ট, বার্লি, চাল (বাদামী এবং লাল), রাই, ওটস, বাজরা, ভুট্টা (শুকনো) এবং জোয়ার।
এই শস্যগুলোর পুরোটা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে, অর্থাৎ শস্যের তুষ, বীজ এবং শস্যের শাঁস—সবকিছুই খাদ্য তালিকায় যোগ করতে হবে।
কারণ, শস্যের এই অংশগুলোতে রয়েছে প্রয়োজনীয় ফাইবার, ভিটামিন এবং খনিজ উপাদান।
এই প্রকল্পের সাফল্যের জন্য ডেনমার্ক সরকার খাদ্য বিষয়ক নির্দেশিকাগুলোতেও পরিবর্তন এনেছে।
২০০৯ সালে, তারা প্রতিদিন খাদ্য তালিকায় শস্য জাতীয় খাবারের চারটি পরিবেশন অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করে।
২০১৩ সালে, এই লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ৭৫ গ্রাম নির্ধারণ করা হয় এবং পরবর্তীতে, গত বছর তা আরও বাড়িয়ে ৯০ গ্রামে উন্নীত করা হয়েছে।
ডেনিশ কর্তৃপক্ষ শস্য জাতীয় খাবারের গুরুত্ব বোঝাতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে।
এর মধ্যে অন্যতম হলো, খাদ্য উৎপাদনকারীদের উৎসাহিত করা।
তারা খাদ্য পণ্যে ‘হোল গ্রেইন’ বা পূর্ণ শস্যের লোগো ব্যবহার করতে শুরু করে, যা ভোক্তাদের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার বাছাই করা সহজ করে তোলে।
এছাড়াও, খাদ্য প্রস্তুতকারকদের ধীরে ধীরে তাদের পণ্যে পূর্ণ শস্যের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে।
ডেনমার্কের এই সাফল্যের কারণ হলো, তারা শুধু একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর উপর নির্ভরশীল না হয়ে খাদ্য বিষয়ক সকল অংশীদারদের একত্রিত করেছে।
সরকার, স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্থা, খাদ্য প্রস্তুতকারক এবং ভোক্তাদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা এই প্রকল্পের মূল ভিত্তি ছিল।
এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের জন্য এই দৃষ্টান্ত কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ?
আমাদের দেশেও হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য বিষয়ক সমস্যা বাড়ছে।
তাই, ডেনমার্কের এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরাও আমাদের খাদ্যভ্যাস পরিবর্তন করতে পারি।
উদাহরণস্বরূপ, সাদা চালের পরিবর্তে ব্রাউন রাইস বা লাল চাল, ময়দার রুটির বদলে আটার রুটি এবং ফাস্ট ফুডের পরিবর্তে শস্য জাতীয় খাবার গ্রহণ করার অভ্যাস তৈরি করা যেতে পারে।
এছাড়াও, খাদ্য বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সরকারের সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে আমরাও একটি স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যৎ গড়তে পারি।
তথ্য সূত্র: The Guardian