মনের ওপর ভর করে শরীরের যন্ত্রণা? বিশেষজ্ঞদের নতুন ধারণা
দীর্ঘদিনের শারীরিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় হয়তো লুকিয়ে আছে আমাদের মনের গভীরে। সম্প্রতি, এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাঁদের মতে, মানসিক চাপ, উদ্বেগের মতো বিষয়গুলো শরীরে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার কারণ হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের শরীর এবং মনের মধ্যে গভীর যোগসূত্র রয়েছে।
তাই অনেক সময় মানসিক সমস্যাগুলো শারীরিক উপসর্গের আকারে প্রকাশ পায়।
ক্লান্তি, মাইগ্রেন, কোষ্ঠকাঠিন্য বা আরও অনেক ধরনের শারীরিক সমস্যার মূলে থাকতে পারে মানসিক চাপ। এই ধারণা দিয়েছেন মনোবিজ্ঞানী নিকোল স্যাকস।
তাঁর নতুন বই, ‘মাইন্ড ইউর বডি: এ রেভোলিউশনারি প্রোগ্রাম টু রিলিজ ক্রনিক পেইন অ্যান্ড অ্যাংজাইটি’- তে তিনি এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক যন্ত্রণা ও মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে সম্পর্ক
নিকোল স্যাকস এবং তাঁর শিক্ষক, ড. জন সার্নো দীর্ঘদিন ধরে এই বিষয়ে কাজ করেছেন।
তাঁদের মতে, ব্যথার কারণ সবসময় শরীরের কোনো অংশে আঘাত বা অসুস্থতা নয়।
অনেক সময় মানসিক চাপ বা অতীতের কোনো আঘাতের কারণেও শরীরে ব্যথা হতে পারে। ড. সার্নো এই অবস্থাকে ‘টেনশন মায়োনিউর্যাল সিনড্রোম’ (TMS) নামে অভিহিত করেছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের শরীরে এমন কিছু প্রক্রিয়া চলে যা আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না, যেমন- রক্ত সঞ্চালন, শ্বাস-প্রশ্বাস, হৃদস্পন্দন ইত্যাদি।
মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা দুঃখ, রাগ, ভয় অথবা উদ্বেগের মতো অনুভূতিগুলো যখন বাড়তে থাকে, তখন শরীরের স্নায়ু সেই চাপ সহ্য করতে না পেরে ব্যথার সৃষ্টি করে।
আমাদের সমাজ জীবনে, অন্যের সঙ্গে সংযোগ রক্ষার জন্য এই অনুভূতিগুলো অনেক সময় চাপা থাকে।
কিন্তু যখন এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন শরীর ব্যথার মাধ্যমে সংকেত পাঠায়।
মনের এই চাপ থেকে মুক্তির উপায় কী?
চিকিৎসকরা বলছেন, এই ধরনের সমস্যার সমাধানে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ।
- প্রথমত, শরীরের এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে।
- দ্বিতীয়ত, জার্নালস্পিক নামক একটি বিশেষ লেখার পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে, যেখানে নিজের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করার সুযোগ থাকে।
- তৃতীয়ত, নিজের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে।
জার্নালস্পিক আসলে কী?
জার্নালস্পিক হলো, নিজের অনুভূতিগুলো একটি নির্দিষ্ট সময়ে, কোনো রকম বাধা ছাড়াই লিখে প্রকাশ করা।
এটি অনেকটা মনের ভেতরের কথাগুলো ডায়েরিতে লেখার মতো।
এই পদ্ধতিতে, একজন ব্যক্তি তাঁর রাগ, দুঃখ, ভয় অথবা উদ্বেগের মতো বিষয়গুলো লিখতে পারেন।
লেখার পরে, সেটি নষ্ট করে ফেলার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
তাঁদের মতে, এটি বিশ্লেষণের জন্য নয়, বরং অনুভূতিগুলো প্রকাশ করার একটি উপায়।
এই পদ্ধতির কার্যকারিতা
বিশেষজ্ঞদের মতে, জার্নালস্পিকের মাধ্যমে মনের ভেতরের জমে থাকা কষ্টগুলো বের করে আনা যায়, যা শরীরের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
এই পদ্ধতিতে, মানসিক চাপ কমিয়ে শারীরিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।
এই ধারণা কি বিজ্ঞানসম্মত?
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, মন ও শরীরের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে চিকিৎসার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক যন্ত্রণা কমানো সম্ভব।
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের অধ্যাপক ড. মাইকেল ডনিনো-র একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মন-নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতির মাধ্যমে চিকিৎসা করা হলে, রোগীদের ব্যথার পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে।
এমনকি, কোভিড-১৯-এর কারণে হওয়া কিছু শারীরিক সমস্যাও এই পদ্ধতিতে ভালো হয়েছে।
শারীরিক যন্ত্রণা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যেকার সম্পর্ক বোঝার মাধ্যমে, আমরা নিজেদের আরও ভালোভাবে বুঝতে পারি এবং শারীরিক কষ্টের কারণগুলো খুঁজে বের করতে পারি।
যদি আপনার শরীরেও দীর্ঘদিন ধরে কোনো ব্যথা থাকে, যা বিভিন্ন চিকিৎসার পরেও কমছে না, তবে একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
কারণ, মনের শান্তির মাধ্যমেই হয়তো আপনি আপনার শারীরিক কষ্টের সমাধান খুঁজে পেতে পারেন।
তথ্য সূত্র: সিএনএন