আফ্রিকার গভীর অরণ্যে বিলুপ্তপ্রায় বামন কুমির শিকারের এক মর্মস্পর্শী চিত্র ক্যামেরাবন্দী করেছেন ফরাসি আলোকচিত্রী থমাস নিকোলন। শিকারীর কাঁধে একটি কুমির, যেন প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের টিকে থাকার এক কঠিন সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। ছবিটি শুধু একটি প্রাণীর শিকারের ঘটনাই নয়, বরং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের এক জটিল বাস্তবতাকে তুলে ধরে।
কঙ্গো বামন কুমির আফ্রিকার একটি দুর্লভ প্রজাতি। আকারে ছোট এবং স্বভাবের দিক থেকে এরা লাজুক হওয়ায় শিকারীদের সহজ শিকারে পরিণত হয়। স্থানীয় শিকারীরা প্রধানত মাংসের জন্য এদের ধরে থাকে।
শুকনো মৌসুমে এই কুমিরগুলো সাধারণত মাটির গর্তে লুকিয়ে থাকে। শিকারীরা লম্বা লতা ব্যবহার করে এদের টেনে বের করে এবং মুখ বেঁধে নিয়ে যায়।
থমাস নিকোলন, পেশায় একজন বন্যপ্রাণী বিষয়ক আলোকচিত্রী। তিনি কঙ্গোর লেক টেলি কমিউনিটি রিজার্ভে গিয়ে ছবি তোলার সুযোগ পান। এখানকার বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সোসাইটি (WCS) স্থানীয় সরকারের সঙ্গে মিলে এই সংরক্ষিত এলাকাটি দেখাশোনা করে।
যদিও এই কুমির প্রজাতি আংশিকভাবে সুরক্ষিত, কিছু নির্দিষ্ট এলাকার স্থানীয় শিকারীদের শিকারের অনুমতি রয়েছে। রিজার্ভের কর্মীরা, যাদের ইকো-গার্ড বলা হয়, তারা এই এলাকার প্রবেশপথে সবসময় টহল দেন।
তাঁদের কাজ হলো চোরা শিকারীদের হাত থেকে বন্যপ্রাণীদের রক্ষা করা।
নিকোলনের তোলা ছবিগুলোতে দেখা যায়, ইকো-গার্ডরা একটি নৌকায় করে শিকারীদের কাছ থেকে উদ্ধার করা কুমিরগুলোকে নিয়ে যাচ্ছে। চোরা শিকারীরা এদের মাংস বিক্রি করে দেয়, যা শহরগুলোতে পাচার হয়ে যায়।
ছবিগুলোতে কুমিরগুলোর মুখ বাঁধা অবস্থায় দেখা যায়, কারণ তাদের কামড় গুরুতর জখম করতে না পারলেও সেলাই করার মতো ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে।
আলোকচিত্রী নিকোলন শিকারীদের গ্রামে কয়েক দিন ছিলেন এবং তাঁদের জীবনযাত্রা কাছ থেকে দেখেছেন। বনের মধ্যে শিকারীদের সঙ্গে সময় কাটানোটা তাঁর কাছে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা ছিল।
তিনি বলেন, “আফ্রিকার গভীর জঙ্গলে বসে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে তাঁদের জীবন ও ভাবনা নিয়ে আলোচনা করাটা আমার ভালো লাগে।”
এই প্রকল্পের শুরুতে নিকোলনের মাথায় একজন শিকারী ও তার শিকারের একটি ছবি তোলার পরিকল্পনা ছিল। বনের বাইরে এসে তিনি ব্রাইস ইতওয়া নামের এক শিকারীর ছবি তোলেন।
ব্রাইস ছিলেন দলের সবচেয়ে দক্ষ শিকারী। নিকোলন চেয়েছিলেন, ছবিতে শিকারের সরঞ্জামসহ ব্রাইসকে উপস্থাপন করতে। ছবিটি তোলার পর ব্রাইসও খুব খুশি হয়েছিলেন, কারণ ছবিগুলো তাঁদের সকলের ঘরে টাঙানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
সাধারণত শিকারীরা কুমিরকে কাঁধে ঝুলিয়ে জঙ্গলে হাঁটে। তবে নিকোলন চেয়েছিলেন, এই ছবি শিকারী এবং কুমির উভয়েরই প্রতিকৃতি হোক। তাই তিনি ব্রাইসকে কুমিরটি সামনের দিকে ধরে রাখতে বলেন।
ছবিটির মাধ্যমে শিকারীদের জীবন এবং তাঁদের জীবিকার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য।
বন থেকে মাংস সংগ্রহ করা আফ্রিকার অনেক সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উপায়। আশির দশকে একজন শিকারী হয়তো একটি বনরুই এবং একটি বানর শিকার করত, যা দিয়ে একটি পরিবারের খাদ্য চাহিদা মিটে যেত।
কিন্তু এখন তারা একইসঙ্গে পাঁচটি বানর, ছয়টি বনরুই এবং দুটি কুমির শিকার করে, যা শুধু খাওয়ার জন্য নয়, বরং বিক্রির উদ্দেশ্যেও করা হয়। ফলে বনের ভেতরের প্রাণী শূন্য হয়ে যাচ্ছে, যা পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ভাষায় ‘এম্পটি ফরেস্ট সিন্ড্রোম’।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সোসাইটির (WCS) প্রধান কাজ হলো, একটি প্রজাতির কতগুলো প্রাণী অবশিষ্ট আছে তা খুঁজে বের করা এবং স্থানীয় ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না করে তাদের সংখ্যা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেই বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া।
থমাস নিকোলন পেশাগত বিভাগে ২০২৩ সালের সনি ওয়ার্ল্ড ফটোগ্রাফি অ্যাওয়ার্ডের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকায় নির্বাচিত হয়েছেন।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান