একসময় ইস্টার ছিল প্রতিরোধের সূচনা, আজকের দিনেও যা প্রাসঙ্গিক।
প্রাচীনকালে, যখন খ্রিস্টধর্ম একটি প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেনি, তখন এটি ছিল নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক নীরব বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের মূল কারণ ছিল দুর্বলদের প্রতি সহানুভূতি এবং সমাজের প্রতিচ্ছবি তৈরি করা। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে, কীভাবে এই আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তা বর্তমান সময়ের জন্যেও শিক্ষণীয়।
১১২ খ্রিস্টাব্দে, আধুনিক তুরস্কের এক রোমান গভর্নর “ক্রিস্টিয়ানি” নামক এক সম্প্রদায়ের কিছু মানুষের মুখোমুখি হন। তিনি শুনেছিলেন, এই সম্প্রদায়ের সদস্যরা এমন একজনের অনুসারী, যাঁকে রোমানরা নির্যাতন করে হত্যা করেছে। তবে তাঁর অনুসারীরা বিশ্বাস করতেন, তিনি এখনও জীবিত।
গভর্নর তাঁদের কার্যকলাপ সম্পর্কে জানতে চান। তিনি বুঝতে পারেন, তাঁরা নিয়মিত মিলিত হন এবং তাঁদের মধ্যে বিশেষ ভোজন হয়, যেখানে তাঁদের নেতার রক্ত পান করা হয় এবং আরও কিছু গোপনীয়তা রয়েছে।
গভর্নর এই সম্প্রদায়ের কয়েকজন নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকেন। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা লিখেছিলেন: “আমি মনে করি, দুজন দাসী, যাদের তারা ডিকনেস বলে, তাদের কাছ থেকে অত্যাচারের মাধ্যমে হলেও সত্য বের করা দরকার। আমি সেখানে কেবল কুরুচিপূর্ণ ও সীমাহীন কুসংস্কার খুঁজে পেয়েছি।”
তিনি সম্রাট ট্রাজানকে জানান, তিনি এই “সংক্রমণ” বন্ধ করার জন্য রোমের কঠোর শাসন প্রয়োগ করেছেন।
কিন্তু এই গভর্নর সম্ভবত সেই বিশাল পরিবর্তনটি বুঝতে পারেননি, যা তাঁর চোখের সামনেই ঘটছিল। সেই অখ্যাত সম্প্রদায়ই একসময় রোমের প্রধান ধর্ম হয়ে উঠবে এবং বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অনুসরণ করা ধর্মে পরিণত হবে। যে ক্রুশকে রোমান সরকার রাজনৈতিক বিপ্লবীদের মৃত্যুদণ্ডের জন্য ব্যবহার করত, সেটিই “বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত ঈশ্বরের প্রতীক” হয়ে উঠবে, যেমনটা স্কলার টম হল্যান্ড তাঁর ‘ডমিনিয়ন: হাউ দ্য খ্রিস্টান রেভোলিউশন রিমেড দ্য ওয়ার্ল্ড’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন।
আজকের দিনে, বিশ্বের প্রায় ২০০ কোটি খ্রিস্টান এই ইস্টার উদযাপন করেন। এই পবিত্র দিনে তাঁরা যিশু খ্রিস্টের পুনরুত্থান স্মরণ করেন।
কিন্তু ইস্টার-এর এই ঘটনা এখানেই শেষ নয়। এর পরবর্তী বছরগুলোতে রোমে যা ঘটেছিল, তা ছিল আরও বিস্ময়কর। খ্রিস্টধর্ম একটি ধর্ম হওয়ার আগে, এটি ছিল প্রতিরোধের এক রূপ — যা দরিদ্র মানুষের একটি আন্দোলন হিসেবে শুরু হয়েছিল এবং ইতিহাসের অন্যতম নিষ্ঠুর সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছিল।
প্রশ্ন হল, প্রথম খ্রিস্টানরা কীভাবে এটা করতে পেরেছিল? বর্তমানের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করা দলগুলো তাঁদের কাছ থেকে কী শিখতে পারে?
প্রথম খ্রিস্টানরা একটি আধ্যাত্মিক প্রয়োজনীয়তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল।
খ্রিস্টানরা এমন একটি বার্তা প্রচার করেছিল, যেখানে বলা হয়েছিল “ঈশ্বর প্রেমস্বরূপ”, যা রোমের পৌত্তলিক ধর্মগুলি পূরণ করতে পারেনি। কিন্তু তাঁরা আরও দুটি কৌশল অবলম্বন করেছিলেন, যা আজকের প্রতিরোধের আন্দোলনের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে:
প্রথমত, সহানুভূতি তৈরি করা:
রোমানদের নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধের পথ খুলে দেয়। তাঁরা প্রায়ই এমন ভুল করতেন, যা স্বৈরাচারী শাসকরা করে থাকে — তাঁরা সীমা অতিক্রম করত। তারা নাগরিকদের জন্য তেমন কোনো সুবিধা দিতে পারছিল না। খ্রিস্টানরা এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে নিজেদের শক্তিশালী করে তুলেছিল।
প্রাচীন রোমে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কতটা কঠিন ছিল, তা আজ কল্পনা করাও কঠিন। দরিদ্র মানুষেরা প্রায়ই ক্ষুধার কারণে মারা যেত। সেখানে কোনো স্বাস্থ্য পরিষেবা ছিল না। গড় আয়ু ছিল প্রায় ৩৫ বছর, কারণ শিশুদের মৃত্যুর হার ছিল অনেক বেশি।
প্রথম খ্রিস্টানরা সম্ভবত রোমের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা জাল তৈরি করেছিল। মহামারীর সময় যখন নেতারা এবং ধনী ব্যক্তিরা শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতেন, তখন তাঁরা অসুস্থ ও মৃত্যুপথযাত্রীদের সেবা করতেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খ্রিস্টানরা অনাথ আশ্রম, হাসপাতাল এবং খাদ্য বিতরণের ব্যবস্থা গড়ে তোলে।
ইতিহাসবিদ অ্যান্ড্রু ক্রিসলিপ বলেন, “রোমে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের মতো কিছু ছিল না। এমনকি প্লেগের সময় ডাক্তাররাও শহর ছেড়ে চলে যেতেন। প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্রের একটি মূলনীতি ছিল, যদি কোনো রোগীর আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা না থাকে, তবে তার চিকিৎসা করা উচিত নয়। খ্রিস্টানদের মধ্যে এমন কোনো দ্বিধা ছিল না। তাঁরা আশা নেই জেনেও রোগীদের চিকিৎসা করতে প্রস্তুত ছিলেন।
এই খ্রিস্টানরা একটি ভিন্ন অর্থনৈতিক মডেলও তৈরি করেছিলেন। তাঁরা গরিবদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতেন এবং দরিদ্রদের আশ্রয় দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন। বাইবেলের নতুন নিয়মের বুক অফ অ্যাক্টস-এ চার্চের উত্থানের কথা বলা হয়েছে, যেখানে তাঁরা তাঁদের সম্পদ পুনর্বণ্টন করতেন।
দ্বিতীয়ত, ভয়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের জন্য অন্যদের সমর্থন:
প্রতিরোধ আন্দোলনকে ধ্বংস করার জন্য স্বৈরাচারীরা যে প্রধান অস্ত্র ব্যবহার করে, তা হল ভয়। ভ্লাদিমির পুতিন তাঁর শাসনের মাধ্যমে রাশিয়ার জনগণের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছেন।
কিন্তু বন্ধু এবং পরিবারের সমর্থন ভয় ও উদাসীনতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের শক্তি যোগায়।
আন্দোলনের শুরুতে অনেক রোমান খ্রিস্টানদের নিয়ে উপহাস করত বা বিপজ্জনক মনে করত। কিন্তু পরিবার ও বন্ধুদের প্রতি ব্যক্তিগত আনুগত্যের কারণেই এই ধর্ম দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল।
ঐতিহাসিক রডনি স্টার্ক লিখেছেন, অনেক খ্রিস্টানের জন্য এই ধর্মে যোগ দেওয়া ছিল একটি “ধর্মতত্ত্ব গ্রহণ করা নয়; বরং বন্ধু এবং পরিবারের সঙ্গে ধর্মীয় আচরণকে একত্রিত করা।
প্রথম খ্রিস্টানরা এমন সম্পর্ক তৈরি করেছিল, যা আগে সমাজে দেখা যায়নি। গ্রিক, ইহুদি, রোমান—ধনী ও গরিব—সবাই একসঙ্গে বাড়িতে প্রার্থনা করত এবং একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। তাঁরা নারীদের নেতা হিসেবে গ্রহণ করত এবং সেই সময়ে দাসদেরও মানুষ হিসেবে দেখত।
ঐতিহাসিক টম হল্যান্ড লিখেছেন, “প্রাচীন বিশ্বে দাসদের এত ঘৃণা করা হতো যে, রোমান পুরুষরা তাঁদের যৌন চাহিদা মেটানোর জন্য দাসী এবং বেশ্যাদের ব্যবহার করতে দ্বিধা করত না, যেমন তারা রাস্তার পাশে শৌচাগার করতে দ্বিধা করত না।”
এই কৌশলগুলো কাজে লাগিয়ে খ্রিস্টান আন্দোলন এতটাই জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, রাজনৈতিক নেতারাও এটিকে থামাতে ব্যর্থ হন। এটি বিদ্রোহের পরিবর্তে সামাজিক স্থিতিশীলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সম্রাট কনস্টানটাইন খ্রিস্টধর্মকে বৈধতা দেন এবং এর প্রসারের জন্য রোমান সাম্রাজ্যের শক্তি ব্যবহার করেন।
তবে খ্রিস্টান প্রতিরোধের সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে কিছু পরিবর্তন আসে। পরিত্রাণ ইহকালে নিপীড়ন থেকে মুক্তির পরিবর্তে পরকালের মুক্তির দিকে বেশি মনোযোগ দেয়।
ক্রিসলিপ বলেছেন, চার্চ একসময় রোমে “আরো নীরবতা ও আনুগত্যের” প্রচার করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চার্চ নিজেই নিপীড়ক হয়ে ওঠে, যা থেকে আমরা ইনকুইজিশন এবং দাসত্বের মতো বিষয়গুলোর উদ্ভব দেখি।
তথ্যসূত্র: সিএনএন