আতঙ্কের দেশে মার্কিন সেনা! গ্যাং নির্মূলে ট্রাম্পের দ্বারস্থ হচ্ছে ইকুয়েডর?

ইকুয়েডরে মাদক চক্র দমনে মার্কিন সামরিক বাহিনীর সহায়তা: প্রেসিডেন্ট নোবোয়ার আবেদন

ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল নোবোয়া দেশটির গ্যাং-নিয়ন্ত্রণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সহায়তা চেয়েছেন। সম্প্রতি দেশটির উপকূলীয় শহর মান্টাতে একটি নৌঘাঁটি নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে, যা মার্কিন সেনাদের ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। এমনটাই জানা গেছে বিভিন্ন সূত্রে।

মান্টা শহরে নির্মাণাধীন নৌঘাঁটিতে ব্যারাক-সদৃশ বাসস্থান ও প্রশাসনিক ভবন তৈরি করা হচ্ছে, যা মার্কিন সামরিক বাহিনীর দীর্ঘমেয়াদী কার্যক্রমের সহায়ক হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন উচ্চপদস্থ ইকুয়েডরীয় কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “ধারণা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে এই স্থানগুলো মার্কিন সেনাদের দ্বারা ব্যবহৃত হবে।”

প্রেসিডেন্ট নোবোয়া প্রকাশ্যে বিদেশি সেনা চেয়েছেন, কারণ গ্যাংগুলোর দৌরাত্ম্যে দেশটি বিপর্যস্ত। আগামী সপ্তাহে ফ্লোরিডায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে অভিবাসন, বাণিজ্য এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা নিয়ে আলোচনার কথা রয়েছে নোবোয়ার।

**গ্যাং সহিংসতার শিকার ইকুয়েডর**

এক সময়ের “শান্তির দ্বীপ” হিসেবে পরিচিত ইকুয়েডর বর্তমানে গ্যাং সহিংসতার শিকার। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নোবোয়া জানান, তিনি যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও ইউরোপীয় দেশগুলোকে গ্যাং বিরোধী যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। মার্চ মাসের শুরুতে তিনি বলেছিলেন, ইকুয়েডর “আন্তর্জাতিক মাদক-সন্ত্রাসী” দলগুলোর সঙ্গে লড়ছে এবং দেশটির “আন্তর্জাতিক বাহিনীর সাহায্য” প্রয়োজন। স্থানীয় একটি রেডিও সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, গুয়াস প্রদেশের মতো অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলোতে বিদেশি সামরিক সহায়তা পাওয়ার জন্য আলোচনা চলছে, তবে কোন দেশগুলো এতে জড়িত, তা তিনি নির্দিষ্ট করে জানাননি।

ইকুয়েডরের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, সশস্ত্র বাহিনী, কৌশলগত গোয়েন্দা কেন্দ্র এবং বিশেষ বাহিনীর আন্তর্জাতিক সহায়তার সমন্বয়ে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

এপ্রিল মাসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বামপন্থী প্রার্থী লুইসা গঞ্জালেজ বিদেশি বাহিনীর উপস্থিতির বিরোধিতা করছেন। তাই নোবোয়ার এই প্রচেষ্টা নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে।

সিএনএন-এর হাতে আসা নির্মাণ পরিকল্পনা অনুযায়ী, ইকুয়েডরের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্প্রতি মান্তার বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যেখানে একটি ১৫০ মিটার দীর্ঘ জেটি নির্মাণ এবং বিদ্যমান বন্দরের আয়তন ৭০০ বর্গমিটারের বেশি বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। বিভিন্ন নথি থেকে জানা যায়, এই প্রকল্পগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন রয়েছে। এমনকি চুক্তি স্বাক্ষরের সময় একজন মার্কিন প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন।

আগস্ট ২০২৪ তারিখের একটি ভাসমান ডকের নকশায় “সাউথকম ফ্লোটিং ডক” লেখা ছিল, যা সম্ভবত মার্কিন সাউদার্ন কমান্ডের (Southcom) প্রতি ইঙ্গিত করে। জুন ২০২৪ তারিখের আরেকটি নকশায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্তর্জাতিক মাদক ও আইন প্রয়োগ বিভাগের (INL) লোগো ব্যবহার করা হয়েছে এবং প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয়েছে “ইকুয়েডরের মাদক-বিরোধী বিশেষ ইউনিট ও ডিইএ-এর জন্য সজ্জিত কন্টেইনার” এবং এটিকে “মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জেমস হিউইট সিএনএনকে জানান, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইকুয়েডরের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যার মধ্যে মান্টাতে সম্প্রতি হওয়া চুক্তিও অন্তর্ভুক্ত এবং আন্তঃদেশীয় অপরাধমূলক সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা সম্প্রসারণের বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে।”

এর আগে ১৯৯৯ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মান্টা বিমানঘাঁটিতে মার্কিন সেনা মোতায়েন ছিল। তখন তারা পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে মাদক পাচার রুটের ওপর নজরদারি চালাত।

নোবোয়া প্রকাশ্যে মার্কিন সরকারের কাছে ইকুয়েডরের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করার আবেদন করেছেন।

ইকুয়েডরের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জিয়ান কার্লো লোফ্রেডো সিএনএনকে বলেন, “অন্য কোনো দেশের সেনা আসলে তারা সম্পদ নিয়ে আসে। আমাদের সবচেয়ে বেশি সেটাই দরকার।”

**গ্যাং সহিংসতা ও দুর্নীতির চিত্র**

ইনসাইট ক্রাইম-এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ইকুয়েডরে লাতিন আমেরিকার মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক হত্যার ঘটনা ঘটছে। মেক্সিকোর তুলনায় এখানে প্রায় দ্বিগুণ মানুষ খুন হয়। মাদক পাচার, গ্যাংগুলোর মধ্যে এলাকা দখলের লড়াই এবং স্থানীয় গ্যাং ও বিদেশি কার্টেলগুলোর মধ্যে জোটের কারণে এই সহিংসতা বাড়ছে।

গুয়াকুইল ও দুরানের মতো শহরগুলোতে ইকুয়েডরের সামরিক বাহিনী ও পুলিশের অভিযানে মাদক ব্যবসার আস্তানা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং সন্দেহভাজনদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এক বাড়িতে নির্যাতনের চিহ্ন পাওয়া গেছে, যেখানে রক্তের দাগ, টেজার ও দড়ি ছিল। অন্য একটি বাড়িতে সান্তা মুয়ের্তের (মৃত্যুর দেবী)-এর পূজা করার স্থান ছিল, যা মেক্সিকোর সিনালোয়া কার্টেল এবং ইকুয়েডরের গ্যাংগুলোর মধ্যে প্রচলিত।

তবে, অভিযান সত্ত্বেও অনেক কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, সহিংসতার মাত্রা কমানো যাচ্ছে না, বরং তা একটি নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক তুলসী গাববার্ড সম্প্রতি সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটিতে দেওয়া সাক্ষ্যে বলেছিলেন, “আমাদের অঞ্চলের কার্টেল, গ্যাং এবং অন্যান্য আন্তঃদেশীয় অপরাধমূলক সংগঠন মাদক পাচার থেকে শুরু করে অর্থ পাচার, অবৈধ অভিবাসী পাচার এবং মানব পাচারের মতো বিভিন্ন অবৈধ কার্যকলাপে জড়িত, যা সাধারণ আমেরিকানদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও কল্যাণের জন্য হুমকিস্বরূপ।”

ইকুয়েডরের অবস্থান– বিশ্বের শীর্ষ কোকেন উৎপাদনকারী দেশ পেরু ও কলম্বিয়ার কাছাকাছি হওয়ায়– এটি মাদক পাচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্ট। ডলার-নির্ভর অর্থনীতি এবং ভিসানীতির শিথিলতা অপরাধীদের অর্থ ও লোক আনা-নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতি এই চক্রকে আরও শক্তিশালী করে।

ইনসাইট ক্রাইমের জেমস বার্জেন্ট বলেছেন, “দুর্নীতি ব্যাপক ও বিস্তৃত। নিম্ন-পর্যায়ের পুলিশ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ক্ষমতার উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত—সবখানেই এর বিস্তার রয়েছে, যা পাচারকে উৎসাহিত করে এবং অপরাধী গোষ্ঠীগুলোকে সুরক্ষা দেয়।”

দুরানের পুলিশ প্রধান রবার্তো সান্তামারিয়া স্বীকার করেছেন যে, পুলিশের মধ্যে দুর্নীতি রয়েছে। তিনি জানান, দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের শনাক্ত করার জন্য তারা মাঝে মাঝে পলিগ্রাফ পরীক্ষার সাহায্য নেন এবং অস্বাভাবিক কার্যকলাপ আছে কিনা, তা জানতে ব্যাংক হিসাব পরীক্ষা করেন।

নোবোয়া তার এই পদক্ষেপকে অভ্যন্তরীণ লড়াই এবং আন্তর্জাতিক সাহায্যের আবেদন হিসেবে তুলে ধরেছেন। আগামী ১৩ এপ্রিলের নির্বাচনের আগে তিনি নিরাপত্তা বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন।

নোবোয়া মনে করেন, বিদেশি সমর্থন কোনো দূরের বিষয় নয়, বরং এটি একটি চলমান কৌশল। ইকুয়েডর সামরিক অবকাঠামো সম্প্রসারণ করছে, রাজনৈতিক বাধাগুলো দূর করছে এবং এই অঞ্চলের সরকার ও নাগরিকদের কাছে বিষয়টি তুলে ধরছে। এখন দেখার বিষয়, এই সাহায্য আসে কিনা, বা কত দ্রুত আসে।

তথ্য সূত্র: সিএনএন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *