বর্তমান বিশ্বে, প্রায় সবকিছুতেই দ্রুততা আর দক্ষতার একচ্ছত্র আধিপত্য। প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে সহজ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও, যেন এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিয়েছে। প্রতিনিয়ত চেষ্টা চলছে কীভাবে আরও দ্রুত কাজ করা যায়, আরও বেশি উৎপাদন করা যায়।
কিন্তু এই দৌরাত্ম্যের ফলস্বরূপ, আমরা কি হারাচ্ছি না আমাদের মানবিকতা? আমাদের আবেগ, অনুভূতি, এবং জীবনের আনন্দগুলো কি ক্রমশ গৌণ হয়ে যাচ্ছে?
সম্প্রতি, প্রযুক্তি জায়ান্ট অ্যাপলের একটি আপডেটের কারণে অনেক ব্যবহারকারী তাদের ইমেইলের সংক্ষিপ্ত সারসংক্ষেপ পেয়েছেন। তাৎক্ষণিকভাবে এই ফিচারটি নিয়ে হাসি-ঠাট্টা শুরু হলেও, এর মাধ্যমে জীবনের কিছু গভীর সমস্যাও সামনে এসেছে।
যেমন, একজন ব্যক্তি তার মায়ের কাছ থেকে পাওয়া একটি সংক্ষিপ্ত বার্তায় জানতে পারলেন, “পাহাড়ে ওঠাটা প্রায় আমাকে মেরেই ফেলেছিল।” মূল বার্তাটি ছিল, “আমি প্রায় আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম, কিন্তু সুস্থ হয়ে রেডল্যান্ডসে পাহাড়ে উঠলাম।
এই ধরনের সংক্ষিপ্তিকরণ, আমাদের জীবনের জটিলতাগুলোকে সরলীকরণ করে, যা আসলে উদ্বেগের কারণ। বর্তমান বিশ্বে, কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
তবে, অতিরিক্ত দক্ষতার পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা অনেক সময় আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো উপেক্ষা করি। যেমন, আমরা বন্ধু বা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর পরিবর্তে অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি। সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনার পরিবর্তে, আমরা ফলাফল-কেন্দ্রিক হয়ে পড়ি।
যুক্তরাষ্ট্রে, এলন মাস্কের ‘ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি’ (Doge) ফেডারেল সরকারের বিভিন্ন বিভাগ থেকে কর্মী ছাঁটাই করেছে। শোনা যাচ্ছে, কর্মীরা সপ্তাহে ১২০ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
এর ফলস্বরূপ, জরুরি বিভাগের কর্মীরাও চাকরি হারাচ্ছেন, যা নিঃসন্দেহে উদ্বেগের কারণ।
যুক্তরাজ্যেও একই চিত্র। সেখানেও, শ্রমিক দল সরকারি ব্যয় সংকোচনের মাধ্যমে অদক্ষতা দূর করতে চাইছে। বেকারত্ব কমাতে এবং অসুস্থতাজনিত ছুটির সংখ্যা হ্রাস করতে ওজন কমানোর ইনজেকশন এবং মানসিক স্বাস্থ্য রোগীদের জন্য চাকরি বিষয়ক পরামর্শ দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
এই ধরনের পদক্ষেপগুলি দুর্বল এবং প্রান্তিক মানুষের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলছে।
দক্ষতার নামে, আমরা আসলে মানবিক সম্পর্কগুলো থেকে দূরে চলে যাচ্ছি। খেলাধুলা, শিল্পকলা, এবং অন্যান্য সৃজনশীল কার্যক্রমগুলোও যেন গুরুত্ব হারাচ্ছে।
এমনকি শিক্ষা ক্ষেত্রেও, শিল্পের গুরুত্ব কমে যাচ্ছে, যা সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশকে দুর্বল করে দিচ্ছে।
কিন্তু এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? সম্ভবত, এর উত্তর নিহিত রয়েছে অদক্ষতাকে আলিঙ্গন করার মধ্যে।
মাঝে মাঝে ধীর গতিতে চলা, পছন্দের কাজ করা, এবং বন্ধু ও পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো—এগুলো আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের মনে রাখতে হবে, জীবনের আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে তাড়াহুড়োর বাইরে, যেখানে আমরা আমাদের আবেগ এবং অনুভূতিকে অনুভব করতে পারি।
আমরা যদি সমাজের এই দ্রুতগতির সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠি, তবে আমাদের নিজেদের জন্য সময় বের করতে হবে। প্রকৃতির কাছাকাছি যাওয়া, বই পড়া, গান শোনা, অথবা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া—এগুলো আমাদের মনকে শান্ত করতে পারে।
এটি আমাদের জীবনের গতিকে কমিয়ে দেবে, তবে আমাদের মানবিকতাকে বাঁচিয়ে রাখবে।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান