রমজান মাসে মিশরের ‘দয়ার টেবিল’, যেখানে কয়েকশ মানুষের ইফতারের ব্যবস্থা
রমজান মাস মুসলিমদের জন্য আত্মশুদ্ধি ও ত্যাগের মাস। সারা বিশ্বজুড়ে এই মাসে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ইবাদতে মশগুল হন।
পবিত্র এই মাসে মিশরে এক ব্যতিক্রমী দৃশ্য দেখা যায়, যা ‘দয়ার টেবিল’ নামে পরিচিত। কায়রোর সৈয়দা জয়নাব এলাকার একটি মসজিদে এই ধরনের একটি টেবিল স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে রোজাদার ও পথচারীদের বিনামূল্যে ইফতার করানো হয়।
সৈয়দা জয়নাব মসজিদটি মিশরের অন্যতম পবিত্র স্থান, যেখানে হযরত মুহাম্মদের (সা.) দৌহিত্রী সৈয়দা জয়নাবের (রা.) মাজার অবস্থিত। রমজান মাসে এই মসজিদের সামনে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের উদ্যোগে গড়ে ওঠে এই ‘দয়ার টেবিল’।
প্রতিদিন সূর্যাস্তের আগে এখানে জড়ো হন বহু মানুষ। নানা বয়সের স্বেচ্ছাসেবকগণ তাঁদের সাধ্যমতো ইফতারের আয়োজন করেন। খাবারের মধ্যে থাকে খেজুর, ভাত, সবজি ও মুরগির মাংস।
এই টেবিলের স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে অন্যতম হলেন হামদি, যিনি পেশায় একজন কফি বিক্রেতা। তিনি জানান, এই ধরনের ‘দয়ার টেবিল’ শুধু সৈয়দা জয়নাবেই নয়, পুরো মিশর জুড়েই রমজান মাসে দেখা যায়।
তিনি আরও বলেন, “মিশরের মানুষজন সহজে একত্রিত হয়ে সাহায্য করতে পারে।” হামদির মতো এখানকার দোকানদার, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষজন সবাই মিলেমিশে এই কাজটি করেন। একদিকে যেমন তাঁরা ব্যবসার ক্ষতি সত্ত্বেও অন্যদের সাহায্য করেন, তেমনি অন্যদিকে তাঁদের এই ত্যাগ সত্যিই প্রশংসার যোগ্য।
এই আয়োজনের পেছনে রয়েছে একটি দীর্ঘ ইতিহাস। জানা যায়, নবম শতকে মিশরের শাসক আহমেদ ইবনে তুলুন প্রথম এই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তবে ফাতেমি সাম্রাজ্যের আমলে এটি আরও জনপ্রিয়তা লাভ করে।
বর্তমানে, কোভিড-১৯ মহামারী ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মিশরের অর্থনীতি যখন চরম সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তখন এই ধরনের মানবিক উদ্যোগ আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
এই ‘দয়ার টেবিল’-এর খাবার আসে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অনুদান ও স্থানীয়দের কাছ থেকে। স্থানীয় বাসিন্দারাও তাঁদের সামর্থ্য অনুযায়ী খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করেন।
এই টেবিলের মূল লক্ষ্য হলো, কোনো ভেদাভেদ ছাড়াই সবার জন্য ইফতারের ব্যবস্থা করা। এখানে ধনী-গরিব, পরিচিত-অপরিচিত—সবার জন্য খাবার উন্মুক্ত থাকে।
টেবিলে বসে থাকা ৭০ বছর বয়সী এক দম্পতি জানান, তাঁরা হাসপাতালে ভর্তি আত্মীয়কে দেখতে এসেছিলেন এবং ইফতারের সময় হওয়ায় এখানে খাবার গ্রহণ করেছেন। এছাড়া, বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শিক্ষার্থী ও অন্য শহর থেকে আসা মানুষেরাও এই টেবিলে ইফতার করেন।
রমজানের তাৎপর্যপূর্ণ এই সময়ে মিশরের এই ‘দয়ার টেবিল’ যেন এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এটি শুধু একটি খাবারের আয়োজন নয়, বরং মানবতা, সহমর্মিতা ও ভালোবাসার এক অনন্য প্রতীক।
এই ধরনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে আমাদের সমাজে পারস্পরিক সহযোগিতা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আরও দৃঢ় করে তোলে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা