গাজায় ঈদ: বোনের স্মৃতি আর ধ্বংসস্তূপের মাঝে বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
ঈদ-উল-ফিতর মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই দিনে সবাই আনন্দ করে, নতুন পোশাকে সেজে ওঠে, আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যাওয়ার ধুম লাগে।
ছোটরা ‘ঈদ সালামি’ (ঈদ উপলক্ষে বড়দের দেওয়া টাকা) পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে। কিন্তু গাজায়, যেখানে ইসরায়েলি বোমা হামলায় ধ্বংসস্তূপ আর মৃত্যুর বিভীষিকা, সেখানে ঈদ যেন এক নীরব শোকের ছায়া।
ফিলিস্তিনের গাজায় বসবাসকারী এক নারীর ঈদ উদযাপন যেন অন্যরকম। এই ঈদে তার সবচেয়ে প্রিয়জন, আদরের ছোট বোন রাহাফ নেই।
গত ২৮শে ডিসেম্বর এক বোমা হামলায় রাহাফ নিহত হয়। তাদের বাড়িটি ধ্বংস হয়ে যায়, কেড়ে নেয় পরিবারের অনেক স্বপ্ন। সেই থেকে শোক আর কষ্টের আগুনে পুড়ে যাওয়া এই নারীর দিনগুলো কাটছে প্রিয়জনের স্মৃতি আর ধ্বংসস্তূপের মাঝে।
রাহাফ ছিল তার একমাত্র বোন, সবচেয়ে ভালো বন্ধু। তারা একসঙ্গে ১৩টি ঈদ উদযাপন করেছে।
ছোটবেলা থেকেই রাহাফ ছিল সবার চোখের মণি। ঈদের দিন সকালে সবার আগে ঘুম থেকে উঠে সে নতুন পোশাকে সেজে বাড়ি দৌড়াতো, যেন ঈদ এসেছে এই ঘোষণা দেওয়ার জন্য।
এরপর দিদি (বড় বোন) চুল বেঁধে দিতো, তারপর তারা দাদীর বাড়িতে যেত, পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে বসে চা খাওয়া, মিষ্টিমুখ করা—এটাই ছিল তাদের ঈদ উদযাপনের রীতি।
কিন্তু এবার আর কিছুই নেই। প্রিয় রাহাফ নেই, নেই তাদের সেই ঘর, যেখানে ঈদ আনন্দের ঢেউ বয়ে যেত।
তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের অনেক স্বপ্ন ছিল, যা বোমা হামলায় কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তারা দু’জন মিলে ঠিক করেছিল, জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে তারা একে অপরের পাশে থাকবে।
দিদি চেয়েছিল রাহাফ একজন শিল্পী হোক, তার ছবিগুলো সারা বিশ্বে পরিচিতি পাক। দিদি চেয়েছিল তার প্রথম বই প্রকাশের দিনে রাহাফ পাশে থাকুক।
বোমা হামলায় যখন তাদের ঘরটি ধ্বংস হয়ে যায়, তখন রাহাফ ঘুমিয়ে ছিল। যে ঘরে রাহাফ ঘুমিয়েছিল, সেই ঘরেই দিদি সাধারণত ঘুমাতো।
ঘটনার চার দিন আগে তারা ঘর বদল করে।
এই শোকের সময়ে, যখন তাদের চারপাশে মৃত্যু আর ধ্বংসের চিহ্ন, তখন শোক প্রকাশ করারও যেন কোনো সুযোগ নেই।
তাদের সাত বছর বয়সী চাচাতো বোন, ক্বামার, দিদির কাছে জানতে চায়, ‘আপু, তোমরা কেন আর বাড়িতে নেই? বাড়িটা কোথায়?’ এই নিষ্পাপ প্রশ্ন শুনে দিদির বুকটা ভেঙে যায়।
ক্বামারকে বোঝানো কঠিন ছিল, রাহাফ আর নেই। দিদি তাকে বুঝিয়েছিল রাহাফ এখন বেহেশতে আছে।
দিদি তখন ক্বামারের হাত ধরে বলেছিল, ‘আমিও তাকে খুব মিস করি। কিন্তু সে সবসময় আমাদের হৃদয়ে থাকবে।’ দিদি জানে, ক্বামার একদিন বুঝবে যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা, যা শুধু ভূমিকে ধ্বংস করে না, মানুষের জীবন কেড়ে নেয়।
গাজার শিশুদের জন্য দিদির মন কাঁদে। তিনি চান, শিশুদের এই কঠিন বাস্তবতা থেকে দূরে রাখতে।
তিনি চান, তাদের হৃদয়ে ভয়, আতঙ্ক বা শোকের ছায়া যেন না পড়ে। যুদ্ধের ভয়াবহতা তাদের স্পর্শ না করুক।
গাজার মানুষ কঠিন পরিস্থিতিতেও টিকে থাকার চেষ্টা করছে, কিন্তু তাদের মানসিক শান্তির কোনো সুযোগ নেই।
বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে। যারা প্রিয়জন হারিয়েছে, তাদের হারানোর বেদনা ভোলার কোনো উপায় নেই।
তবুও, তারা তাদের প্রিয়জনদের ভালোবাসার স্মৃতি বুকে ধরে বেঁচে আছে। তাদের স্মৃতি, তাদের কথা, তাদের অস্তিত্ব—এগুলোই তাদের টিকে থাকার শক্তি যোগায়।
ধ্বংসস্তূপের মাঝেও তারা আলোর সন্ধান করে, বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে ফেরে। তাদের এই বেঁচে থাকা, তাদের প্রতিরোধ—এটাই তাদের পরিচয়।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা