**এলন মাইলস: গেরিলা গার্ডেনিংয়ের মাধ্যমে আশা ও সবুজের বীজ বপন**
বিশ্বজুড়ে শহরের সংখ্যা বাড়ছে, আর মানুষজন প্রকৃতির সান্নিধ্য থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। কংক্রিট আর কাঁচের এই শহরে সবুজ যেন ক্রমশই দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে।
এমন পরিস্থিতিতে, লন্ডনের পরিবেশকর্মী, একত্রিশ বছর বয়সী এলন মাইলস, নগর জীবনে প্রকৃতির অভাব দূর করতে এক অভিনব উপায় খুঁজে বের করেছেন। তাঁর কৌশল, গেরিলা গার্ডেনিং।
এলন মনে করেন, “শহর তৈরি হওয়ার আগে, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক ছিল। এখন যেন সবুজ আমাদের কাছে একটি ‘পরের ভাবনা’।”
মানুষের এই প্রকৃতি-বিচ্ছিন্নতাকে দূর করতে, এলন প্রতিষ্ঠা করেন ‘ন্যাচার ইজ আ হিউম্যান রাইট’ নামে একটি সংগঠন। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল, সকলের জন্য সবুজ স্থানের অধিকারকে মানবাধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া।
কিন্তু সরকারি পর্যায়ে পরিবর্তন আসার দীর্ঘসূত্রিতা দেখে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। তাই, তিনি নিজেই এই পরিবর্তনের সূচনা করেন। তাঁর হাতিয়ার ছিল—ব্যানার বা প্রতিবাদ নয়, বরং বীজ আর কোদাল!
এলন ‘গেরিলা গার্ডেনার’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এই পদ্ধতিতে শহরের অব্যবহৃত স্থানগুলোতে—রাস্তার পাশে, ফুটপাতের ফাটলে, পরিত্যক্ত জমিতে—ফুল ও গাছের চারা রোপণ করা হয়।
অনেকটা দেয়ালের ক্যানভাসে যেমন শিল্পীরা ছবি আঁকেন, তেমনই এলন ও তাঁর দল পরিত্যক্ত স্থানগুলোকে সবুজে রাঙিয়ে তোলেন। ২০১৯-২০ সালের কোভিড মহামারীর সময় যখন পার্কগুলো বন্ধ ছিল, তখন এলন ও তাঁর প্রতিবেশীরা একত্রিত হয়ে হ্যাকনির পরিত্যক্ত স্থানগুলোতে ফুল ও অন্যান্য গাছ লাগানো শুরু করেন।
এটি এখন তাঁদের সাপ্তাহিক রুটিনে পরিণত হয়েছে।
যুক্তরাজ্যে গেরিলা গার্ডেনিং এখনো একটি বিতর্কিত বিষয়। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া সরকারি জায়গায় গাছ লাগানো বেআইনি, তবে অনেক সময় কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে নীরব থাকে।
তবে, রোপণের ফলে যেন অন্যদের কোনো অসুবিধা না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়।
পথচারীদের চলাচলে যেন কোনো বাধা সৃষ্টি না হয় বা গাছপালা লাগানোর কারণে যেন রাস্তাঘাটের ক্ষতি না হয়, সে বিষয়গুলোও নজরে রাখতে হয়।
এই গেরিলা গার্ডেনিং ধারণা নতুন নয়। ১৯৭০-এর দশকে, যুক্তরাষ্ট্রে ‘গ্রিন গেরিলাস’ নামের একটি দল পরিত্যক্ত জায়গাগুলোকে বাগানে পরিণত করার মাধ্যমে এর সূচনা করে। এরপর এই আন্দোলন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পরে।
লস অ্যাঞ্জেলেসের ‘ গ্যাংস্টা গার্ডেনার’ রন ফিনলে থেকে শুরু করে ফ্রান্সের ‘তা মেরে নেচার’, এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকার ‘উজামা গেরিলা গার্ডেনিং কালেকটিভ’—এরা সবাই এই আন্দোলনের অংশ।
এলন তাঁর কাজকে টিকটক ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। তাঁর ভিডিওগুলোতে বীজ বোমা তৈরি থেকে শুরু করে দেয়ালের ওপরের মস গ্রাফিতি—সবকিছুই সহজভাবে ব্যাখ্যা করা হয়।
এলন নিজেই স্বীকার করেন, তিনি প্রথমে একজন অভিজ্ঞ মালী ছিলেন না, তবে কাজটি করতে গিয়েই শিখেছেন। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল, শহরকে সবুজ করে তোলা।
এলনের এই কাজে তরুণ প্রজন্মের সমর্থন বাড়ছে। এলন বলেন, “বর্তমান তরুণ সমাজ জলবায়ু পরিবর্তন, বৈষম্য এবং মানসিক স্বাস্থ্য—এসব বিষয় নিয়ে সচেতন। গেরিলা গার্ডেনিং এই সবের সঙ্গে জড়িত।
এটি এমন কিছু যা আপনি নিজের হাতে করতে পারেন এবং তাৎক্ষণিক ফল দেখতে পারেন।” তিনি আরও যোগ করেন, “অনেক সময় মনে হয়, প্রতিবাদের ফল পাওয়া কঠিন। কিন্তু গেরিলা গার্ডেনিংয়ের মাধ্যমে আপনি সরাসরি এর ফলাফল দেখতে পান, যা খুবই শক্তিশালী।”
সবুজ স্থানের গুরুত্ব শুধু প্রতীকী নয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর খাবারের মতোই সবুজ স্থানে সময় কাটানো মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি।
যুক্তরাজ্যের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সপ্তাহে অন্তত ১২০ মিনিট সবুজ স্থানে কাটান, তাঁদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য অন্যদের চেয়ে ভালো থাকে।
এমনকি শিশুদের ক্ষেত্রেও, সবুজ স্থানে সময় কাটানো তাদের মনোযোগ বাড়াতে ও অতিচঞ্চলতা কমাতে সাহায্য করে।
এছাড়া, পরিত্যক্ত স্থানগুলোকে সবুজায়নের মাধ্যমে অপরাধের হারও কমানো সম্ভব।
এলনের মূল বার্তা হলো, যে কেউ এই কাজে অংশ নিতে পারে।
তিনি বলেন, “এখন বসন্তকাল চলছে। স্থানীয় প্রজাতির বুনো ফুল খুঁজে বের করুন, বৃষ্টির সময় সেগুলো ছড়িয়ে দিন। তাহলে আপনাকে পানি দেওয়ারও প্রয়োজন হবে না।”
যারা আরও বিস্তারিত জানতে চান, তাঁদের জন্য এলন একটি বই লিখেছেন এবং একটি অনলাইন কোর্সও পরিচালনা করেন। এই কোর্সে ৩০০ জনের বেশি অংশগ্রহণকারী রয়েছে।
এলন দলবদ্ধভাবে বাগান করার পরামর্শ দেন, কারণ এতে কমিউনিটির বন্ধন দৃঢ় হয়।
এলনের একটি স্বপ্ন আছে—“কেন আমাদের ফুটপাতগুলো লতাপাতা দিয়ে ঘেরা হবে না? আমাদের ভবনগুলো কেন গাছপালা দিয়ে আচ্ছাদিত হবে না? আমাদের বাড়ির ছাদ আর বাসস্টপগুলো কেন ফুলে ফুলে সজ্জিত হবে না?”
তথ্যসূত্র: সিএনএন