দক্ষিণ আফ্রিকার একটি বিতর্কিত গান ‘ডুবুল’ ইভূনু’ (Kill the Boer) নিয়ে সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে আলোচনা চলছে। গানটি শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘুদের হত্যা করার আহ্বান জানায় এমন অভিযোগ তুলেছেন অনেকে।
অন্যদিকে, এই গানের মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসকেই তুলে ধরা হয়েছে বলে মনে করেন কেউ কেউ। বিতর্কটি এখন শুধু দক্ষিণ আফ্রিকার গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
এই গানের সূত্র ধরে আলোচনা শুরু করেছেন বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক। তিনি সম্প্রতি এক টুইটে দক্ষিণ আফ্রিকার একটি রাজনৈতিক দলের (ইকোনমিক ফ্রিডম ফাইটার্স-ইএফএফ) বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গদের গণহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ করেছেন।
এই দলের নেতা জুলিয়াস মালেমার একটি ভিডিও শেয়ার করে মাস্ক তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। ভিডিওটিতে মালেমাকে ‘ডুবুল’ ইভূনু’ গানটি গাইতে দেখা যায়।
গানটির বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘বোরদের হত্যা করো’ বা ‘শ্বেতাঙ্গ কৃষককে হত্যা করো’।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও মাস্কের এই পোস্টটি শেয়ার করেছেন। এরপর মার্কিন রাজনীতিবিদদের মধ্যেও এই গান নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।
কেউ কেউ গানটিকে ঘৃণা ভাষণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, আবার কেউ এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন।
আসলে ‘ডুবুল’ ইভূনু’ গানটি দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের সময়কার একটি গুরুত্বপূর্ণ গান। ১৯৮০-এর দশকে শ্বেতাঙ্গ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে এটি প্রায়ই গাওয়া হতো।
‘বোর’ শব্দটি মূলত ডাচ বংশোদ্ভূত শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের বোঝাতে ব্যবহৃত হতো।
তবে, সময়ের সাথে সাথে এটি শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর প্রতীক হিসেবেও পরিচিতি লাভ করে।
গানটি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নেতারা এখনো এর পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলছেন। ইএফএফ নেতা জুলিয়াস মালেমা প্রায়ই তার রাজনৈতিক সমাবেশে গানটি গেয়ে থাকেন।
তার মতে, এই গান শ্বেতাঙ্গদের প্রতি ঘৃণা নয়, বরং দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের একটি অংশ।
অন্যদিকে, শ্বেতাঙ্গদের অধিকার নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠন আফ্রিকানারদের অধিকারের কথা তুলে ধরে এই গানের সমালোচনা করেছে।
তাদের মতে, গানটি শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের মধ্যে ভীতি তৈরি করে এবং বিভেদ বাড়ায়।
আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি) দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ আফ্রিকা শাসন করছে।
তবে, দুর্নীতির অভিযোগ এবং জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় দলটির জনপ্রিয়তা কমেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, মালেমা এই গান ব্যবহার করে এএনসির বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরতে চাইছেন।
আইনগতভাবেও গানটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
অতীতে আদালত গানটিকে ঘৃণা ভাষণ হিসেবে রায় দিলেও, সম্প্রতি একটি আদালত জানিয়েছে, মালেমার গান গাওয়া আসলে তার রাজনৈতিক অধিকারের বহিঃপ্রকাশ।
এই বিতর্কের ঢেউ লেগেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও।
অনেকে মনে করছেন, দক্ষিণ আফ্রিকার এই ইস্যুটিকে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে।
বিশেষ করে, ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইলন মাস্কের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এই বিষয়ে তাদের মতামত দেওয়ার মাধ্যমে বিষয়টি আরও আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার এই গান বিষয়ক বিতর্ক, দেশটির রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
এটি একদিকে যেমন বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক, তেমনি শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভীতি ও উদ্বেগের কারণ।
এই জটিল পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং ভবিষ্যতে এর আরও বহু আলোচনা ও বিতর্কের জন্ম দেবে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা