সংবাদ: মেসেজিং অ্যাপে গোপনীয়তা, বাড়ছে সরকারি স্বচ্ছতা নিয়ে উদ্বেগ!

গোপনীয়তা রক্ষার প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসা এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপগুলো প্রায়ই সরকারি স্বচ্ছতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সম্প্রতি, যুক্তরাষ্ট্রের মাউইতে ভয়াবহ দাবানলের সময় সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যেকার কিছু বার্তা আদান-প্রদানের ঘটনা এই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

২০২৩ সালের মাউইয়ের দাবানলে একশ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। জরুরি বিভাগের কর্মীরা ঘটনার পর টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে তাদের কাজের বিবরণ আদান-প্রদান করেন, যা পরবর্তীতে তদন্তকারীদের সরকারি পদক্ষেপগুলো বুঝতে সহায়তা করেছে। তবে, টেক্সট আদান-প্রদানের সময় কর্মকর্তাদের মধ্যে এমন একটি আলোচনা হয় যেখানে তারা সম্ভবত দ্বিতীয় একটি, যা খুঁজে বের করা কঠিন, এমন মেসেজিং অ্যাপ ব্যবহার করছিলেন।

সে সময়কার মাউই জরুরি ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান, হারমান আন্দায়া, এক সহকর্মীকে জানান, “সিগন্যাল অ্যাপটি সম্ভবত এই কাজের জন্যই ব্যবহার করা হতো।” সিগন্যাল এর মতো এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপগুলোতে বার্তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুছে ফেলার সুবিধা থাকে। ব্যবহারকারীদের তথ্যের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিলেও, অনেক সময় এসব অ্যাপ সরকারি নথিপত্র বিষয়ক আইনকে এড়িয়ে যায়। এর ফলে, সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে জনসাধারণের জানার সুযোগ কমে আসে।

যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যে পরিচালিত এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১,১০০ জনের বেশি সরকারি কর্মচারী ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মোবাইল নম্বরের সাথে এনক্রিপ্টেড প্ল্যাটফর্মের অ্যাকাউন্ট যুক্ত রয়েছে। মাউইয়ের কর্মকর্তারা সত্যিই এই অ্যাপ ব্যবহার করেছিলেন কিনা, তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে, বিষয়টি সরকারি সংস্থাগুলোর জন্য একটি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে: নিরাপত্তা বজায় রেখে কীভাবে তারা প্রযুক্তি ব্যবহার করবে, যেখানে তথ্য প্রকাশ ও স্বচ্ছতার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।

এই ধরনের এনক্রিপ্টেড অ্যাপগুলোর ব্যবহার কি ব্যাপক? অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রায় সব রাজ্যেই সরকারি কর্মকর্তাদের অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এদের মধ্যে আইনপ্রণেতা, রাজ্য গভর্নর, অ্যাটর্নি জেনারেল, শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা এবং স্কুল বোর্ডের সদস্যও রয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে সরকারি মোবাইল নম্বরের সাথে এই অ্যাকাউন্টগুলো নিবন্ধিত হলেও, কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যবহারকারীরা সহজে খুঁজে পাওয়ার মতো করে অ্যাকাউন্ট তৈরি করেন না বলে, এই তালিকাটি সম্ভবত সম্পূর্ণ নয়।

মিসৌরি, ওরেগন, ওকলাহোমা, মেরিল্যান্ডসহ বিভিন্ন স্থানে গত এক দশকে এই অ্যাপগুলোর অপব্যবহারের খবর পাওয়া গেছে। সাধারণত, বার্তা ফাঁস হয়ে যাওয়ার কারণে এমনটা ঘটে। জনসাধারণের মাঝে প্রায়ই হ্যাকিং ও ডেটা ফাঁসের বিষয়ে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়। কিন্তু গোপনীয়তা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে তৈরি প্রযুক্তি প্রায়ই সরকারি স্বচ্ছতাকে বাধা দেয়।

সিগন্যাল, হোয়াটসঅ্যাপ, কনফিড, টেলিগ্রামের মতো অ্যাপগুলোতে এনক্রিপশন ব্যবহার করা হয়, যা কেবল নির্দিষ্ট ব্যবহারকারীর পক্ষেই পাঠ্য বার্তার পাঠোদ্ধার করতে সহায়তা করে। সাধারণত, এসব বার্তা সরকারি সার্ভারে সংরক্ষণ করা হয় না। কিছু অ্যাপে বার্তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুছে যায়, আবার কোনোটিতে স্ক্রিনশট বা বার্তা শেয়ার করারও সুযোগ থাকে না।

“আসলে, ব্যক্তিগত যোগাযোগের জন্য এনক্রিপ্টেড অ্যাপ ব্যবহার করার অধিকার সবারই আছে এবং ব্যক্তিগত ডিভাইসে সেগুলো রাখারও অধিকার রয়েছে। এটি কোনো বেআইনি কাজ নয়,”

এমনটা বলেন কর্পোরেট কমপ্লায়েন্স ও গভর্ন্যান্স বিষয়ক নিউজলেটার ‘র‍্যাডিক্যাল কমপ্লায়েন্স’-এর সম্পাদক ম্যাট কেলি।

তিনি আরও বলেন, “কিন্তু একটি সংস্থা কীভাবে বুঝতে পারবে যে একজন কর্মচারী কোন কাজে এই অ্যাপ ব্যবহার করছে?”

এনক্রিপ্টেড অ্যাপের কি সরকারি ব্যবহার গ্রহণযোগ্য? যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার নিরাপত্তা ও অবকাঠামো নিরাপত্তা সংস্থা (সিআইএসএ) সুপারিশ করেছে যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, যারা সংবেদনশীল তথ্য নিয়ে কাজ করেন, তাদের গোপন যোগাযোগের জন্য এনক্রিপশন অ্যাপ ব্যবহার করা উচিত। তবে, তারা সরকারি কর্মকর্তাদের তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য এই অ্যাপ ব্যবহার করতে উৎসাহিত করেনি, যাতে তারা তথ্য প্রকাশ বিষয়ক আইন এড়িয়ে যেতে পারেন। সাংবাদিকদের জন্য, বিশেষ করে যারা সংবাদের জন্য সূত্র বা হুইসেলব্লোয়ারদের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের জন্য এনক্রিপ্টেড মেসেজ ব্যবহার করা বেশ প্রয়োজনীয়।

বর্তমানে, অনেক রাজ্য ও শহর স্বচ্ছতা রক্ষার উপায় খুঁজছে। তবে, প্রযুক্তি দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে, আর পাবলিক রেকর্ড বিষয়ক আইনগুলো সেভাবে তৈরি হয়নি। এমনটা বলছেন, ডিজিটাল যোগাযোগ সংরক্ষণে সহায়তা করা প্রতিষ্ঠান ‘স্মারশ’-এর জেনারেল ম্যানেজার লানিকা মামাক। তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে সবাই সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে বেশি চিন্তিত। তারা তাদের তথ্য সুরক্ষিত রাখতে চাইছে। আমার মনে হয়, তারা নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে।”

মামাক জানান, তাদের কাছে মূলত স্থানীয় সরকারগুলোর কাছ থেকে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হচ্ছে। তবে, অনেকেই অ্যাপ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করেনি বা তাদের ব্যবহারের নিয়মও স্পষ্ট করেনি।

২০২০ সালে, নিউ মেক্সিকো শিশু, যুব ও পরিবার বিভাগের নতুন পরিচালক কর্মীদের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য সিগন্যাল অ্যাপ ব্যবহার করতে এবং ২৪ ঘণ্টা পর বার্তা মুছে ফেলতে বলেন। ২০২১ সালে নিউ মেক্সিকোর নথি সংরক্ষণ বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগের তদন্তের পর, পরিচালক পদত্যাগ করেন। তবে, এনক্রিপ্টেড অ্যাপ ব্যবহারের বিষয়ে নিউ মেক্সিকোতে এখনো কোনো নিয়ম তৈরি হয়নি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ডিসেম্বর, ২০২৪ পর্যন্ত অন্তত তিনজন বিভাগীয় পরিচালক বা সংস্থার প্রধানের সিগন্যাল অ্যাকাউন্ট ছিল।

মিশিগানে ২০২১ সালে, রাজ্য পুলিশের কর্মকর্তারা সরকারি ডিভাইসে সিগন্যাল ব্যবহার করছিলেন। এর প্রতিক্রিয়ায়, মিশিগান আইনপ্রণেতারা সরকারি কর্মচারীদের কর্মক্ষেত্রে ব্যবহৃত ডিভাইসে এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপ ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন, যদি তা জনসাধারণের তথ্য জানার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে।

তবে, মিশিগানের আইনে এই বিধি লঙ্ঘনের জন্য কোনো শাস্তির ব্যবস্থা ছিল না। এছাড়া, নির্বাহী বিভাগের ৪৮,০০০ কর্মচারীর সরকারি ডিভাইসগুলোর উপর নজরদারি করা বেশ কঠিন।

তাহলে, এর সমাধান কী? ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ব্রেকনার ফ্রিডম অব ইনফরমেশন প্রজেক্ট’-এর পরিচালক ডেভিড কুইলিয়ারের মতে, এর সেরা সমাধান হলো পাবলিক রেকর্ড বিষয়ক আইনকে আরও শক্তিশালী করা। তিনি আরও বলেন, “সরকারকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, তারা অন্য যেকোনো সরকারি নথির মতো, এইসব যোগাযোগের তথ্য সংরক্ষণ করতে পারবে।”

কুইলিয়ার জানান, গত কয়েক দশকে সরকারি স্বচ্ছতা কমেছে। এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য সরকার স্বাধীন প্রয়োগকারী সংস্থা তৈরি করতে পারে, বিধি লঙ্ঘনের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারে এবং প্রযুক্তিনির্ভর একটি স্বচ্ছ সংস্কৃতির জন্ম দিতে পারে।

তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *