এস্তোনিয়ায় অনুষ্ঠিত হলো ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত ও নৃত্য উৎসব, যেখানে কণ্ঠ মেলায় মিলিত হয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ। টানা কয়েকদিন ধরে চলা এই উৎসবে দেশের সংস্কৃতি আর জাতীয়তাবোধের এক দারুণ চিত্র ফুটে ওঠে, যা আজও দেশটির মানুষের কাছে অত্যন্ত গর্বের বিষয়।
বৃষ্টির মধ্যেও উৎসবের উন্মাদনা ছিল চোখে পড়ার মতো।
তালিনে বিশাল এক উন্মুক্ত স্থানে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়, যেখানে ২১ হাজারের বেশি কণ্ঠশিল্পী এবং বিপুল সংখ্যক দর্শক-শ্রোতা অংশ নেন।
সবার পরনে ছিল ঐতিহ্যবাহী পোশাক।
এই উৎসবের মূল আকর্ষণ হলো এস্তোনিয়ার লোকসংগীত ও দেশাত্মবোধক গান।
সাধারণত প্রতি পাঁচ বছর পর পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
উনিশ শতকে এর সূচনা হলেও, পরবর্তীতে এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসন থেকে মুক্তি পেতে ‘Singing Revolution’ বা গান-এর বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
এস্তোনিয়ার মানুষের জাতীয় জীবনে এই উৎসব আজও গভীর প্রভাব ফেলে।
জানা যায়, মূল কনসার্টের টিকিট কয়েক সপ্তাহ আগেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল।
উৎসবের অন্যতম পরিচালক রাসমুস পুরের মতে, বর্তমান বিশ্বে অস্থিরতা এবং বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে, এস্তোনিয়ার মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ হতে চাইছে।
দেশের প্রতি ভালোবাসার এই অনুভূতি তাদের মধ্যে আরও দৃঢ় হয়েছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে, এই উৎসবের শুরুটা হয়েছিল রাশিয়ার সাম্রাজ্যের সময়কালে।
১৮৬৯ সালে টার্তু শহরে প্রথম গানের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, যা এস্তোনিয়ার মানুষের মধ্যে নতুন করে জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে তোলে।
ভাষা, সংস্কৃতি এবং থিয়েটারের উন্নতি হতে থাকে।
পরবর্তীতে, দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝে এবং সোভিয়েত শাসনের প্রায় ৫০ বছর ধরে এই উৎসব অব্যাহত ছিল।
সোভিয়েত শাসকরা সবসময় বিশাল আকারের অনুষ্ঠান করতে পছন্দ করত।
তাই তারা এই উৎসবকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাতে চেয়েছিল।
যদিও তখন এস্তোনিয়ার মানুষকে রাশিয়ান ভাষায় সোভিয়েত প্রচারমূলক গান গাইতে হতো, তারা নিজেদের ভাষায় গান গাওয়ারও সুযোগ পেত।
এর মাধ্যমে তারা একদিকে যেমন নিজেদের সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করত, তেমনি শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও জানাত।
এই ধরনের বিশাল উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে এস্তোনিয়ার মানুষের মধ্যে দলবদ্ধভাবে কাজ করার মানসিকতা তৈরি হয়েছিল।
১৯৮০-এর দশকে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময়, সোভিয়েত শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে গান গাওয়ার এই ঐতিহ্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
‘Singing Revolution’-এর সময় এস্তোনিয়া, লাটভিয়া এবং লিথুয়ানিয়ার প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ একত্রিত হয়ে ৬০০ কিলোমিটার দীর্ঘ মানব শৃঙ্খল তৈরি করে গান গেয়ে সোভিয়েত শাসনের প্রতিবাদ জানায়।
জাতিসংঘের সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কো (UNESCO) ২০০৩ সালে এস্তোনিয়ার এই লোকসংগীত উৎসব এবং লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়ার অনুরূপ অনুষ্ঠানগুলিকে ‘অদৃশ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
উৎসবের একজন শিল্পী মারিনা নুরমিং জানান, ১৯৮০-র দশকে তিনি ‘Singing Revolution’-এর অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, সেই সময়টা ছিল যখন ‘আমরা গান গেয়ে নিজেদের মুক্ত করেছিলাম’।
বর্তমানে তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা এস্তোনিয়ানদের একটি কোয়ারের সদস্য।
এবছরের উৎসবে ১০,০০০ এর বেশি নৃত্যশিল্পী বিভিন্ন স্টেডিয়ামে পারফর্ম করেন।
এছাড়াও ছিল লোকসংগীতের বাদ্যযন্ত্রের কনসার্ট।
উৎসবের শেষ দিনে প্রায় ৩২ হাজার কণ্ঠশিল্পী একটি বিশাল কনসার্টে অংশ নেন।
সবাই ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সজ্জিত হয়ে শহরের কেন্দ্র থেকে উৎসবের মাঠ পর্যন্ত এক বিশাল শোভাযাত্রা করে।
এই উৎসবে বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশ নেয়, যাদের বয়স ৬ থেকে ৯৩ বছর পর্যন্ত।
উৎসবে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন কার্ল কেসকুলার মতো সাধারণ মানুষ, যারা মূলত নিজেদের কাজকর্মের পাশাপাশি এই উৎসবে গান করেন।
কার্ল জানান, এই উৎসবে অংশ নেওয়াটা তার কাছে খুবই বিশেষ একটা অনুভূতি ছিল।
উৎসবের এবারের থিম ছিল আঞ্চলিক ভাষা ও উপভাষা।
উৎসবের পরিচালক হেলী জুরগেনসন জানান, গানের মাধ্যমে সবাই একসঙ্গে মিলিত হয় এবং নিজেদের দুঃখ-কষ্ট ভুলে যায়।
উৎসবের শেষ গানটি ছিল ‘আমার মাতৃভূমি আমার ভালোবাসা’।
যা ১৯৬০ সালের একটি উৎসবে সোভিয়েত শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে গাওয়া হয়েছিল।
এই গানটি সবার মনে গভীর আবেগ সৃষ্টি করে।
এস্তোনিয়ার মানুষের কাছে এই উৎসব তাদের জাতীয় পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
তারা বিশ্বাস করে, কঠিন সময়ে গান ও নাচের মাধ্যমে তারা সবসময় ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস