ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সর্বোচ্চ মানবাধিকার পুরস্কার, সাখারভ পুরস্কার ২০২৩ পেলেন দুইজন সাহসী সাংবাদিক। এদের একজন বেলারুশের এবং অন্যজন জর্জিয়ার। বুধবার ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট রবার্টা মেটসোলা এই ঘোষণা করেন।
বেলারুশের সাংবাদিক আন্দ্রেই পোকোবুত, যিনি প্রভাবশালী পোলিশ সংবাদপত্র গ্যাজেটা উইবোরচায়-এর হয়ে কাজ করেন, বর্তমানে কারাগারে বন্দী রয়েছেন। তাকে ‘বেলারুশের জাতীয় নিরাপত্তা’র ক্ষতি করার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে আট বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
তিনি নোভোপোলোতস্কের একটি কারাগারে সাজা ভোগ করছেন। অন্যদিকে, জর্জিয়ার অনুসন্ধানী সাংবাদিক মিজিয়া আমাঘলোবেলি। তিনি জর্জিয়ার দুটি স্বাধীন গণমাধ্যমের প্রতিষ্ঠাতা।
গত আগস্টে সরকার বিরোধী বিক্ষোভে এক পুলিশ প্রধানকে চড় মারার অভিযোগে তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই মামলার তীব্র নিন্দা করে একে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা হিসেবে অভিহিত করেছে।
মেটসোলা বলেন, “এই দুই সাহসী সাংবাদিক তাঁদের কাজের জন্য এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য মিথ্যা অভিযোগে বর্তমানে কারারুদ্ধ। তাঁদের সাহস স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সংগ্রামের প্রতীক।
প্রতি বছর এই পুরস্কার দেওয়া হয়। সোভিয়েত ভিন্নমতাবলম্বী এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী আন্দ্রেই সাখারভের নামে এর নামকরণ করা হয়েছে। ১৯৮৮ সালে এই পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়।
যারা মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষার জন্য কাজ করেন, তাঁদের এই সম্মাননা দেওয়া হয়। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থীদের মধ্য থেকে সিনিয়র ইইউ আইনপ্রণেতারা বিজয়ী নির্বাচন করেন।
ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বলেছে, এই পুরস্কার মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সর্বোচ্চ সম্মান। বেলারুশের বিরোধী দলের নেতা স্বেতলানা সিখানোভস্কায়া আইনপ্রণেতাদের বলেন, পোকোবুত এবং “সাহসী” আমাঘলোবেলির এই পুরস্কার প্রাপ্তি সকল রাজবন্দীর জন্য একটি শক্তিশালী বার্তা যে, তাঁরা একা নন এবং সাংবাদিকতা কোনো অপরাধ নয়।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালে স্বেতলানা সিখানোভস্কায়া এবং তাঁর স্বামী সিয়ার্হাই সিখানোভস্কাই, যাঁরা উভয়েই প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর শাসনের বিরোধী, তাঁরাও সাখারভ পুরস্কার জিতেছিলেন।
৫২ বছর বয়সী পোকোবুত হৃদরোগে ভুগছেন। মানবাধিকার কর্মীরা জানিয়েছেন, তাঁকে একাধিকবার, এমনকি ছয় মাস পর্যন্ত একাকী কারাবাসে রাখা হয়েছিল।
পোকোবুতের পত্রিকা আশা প্রকাশ করেছে, এই পুরস্কার “ঘটনার একটি ঢেউ তৈরি করবে। আমাদের বেলারুশীয় সহকর্মীর মুক্তি এতে ত্বরান্বিত হবে। আন্দ্রেইয়ের ভাগ্য অবশেষে লুকাশেঙ্কোর বিশেষ পরিষেবা এবং পোল্যান্ডের মধ্যেকার খেলা থাকবে না।
এটি পুরো ইউরোপের বিষয়। “ইউরোপের শেষ স্বৈরশাসক” হিসেবে পরিচিত লুকাশেঙ্কো তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বেলারুশ শাসন করছেন।
পশ্চিমা বিশ্ব এই দেশের নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়ে ক্ষমতা ধরে রেখেছেন তিনি। ২০২০ সালের বিক্ষোভের পর, যেখানে কয়েক লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল, ৬,০০০ জনের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়, হাজার হাজার মানুষকে মারধর করা হয় এবং শত শত স্বাধীন গণমাধ্যম ও বেসরকারি সংস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আমাঘলোবেলির ঘটনা জর্জিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম, যা আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচিত হয়েছে। দেশটির ক্ষমতাসীন দল ‘জর্জিয়ান ড্রিম’ সরকারের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজ এবং গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করার অভিযোগ উঠেছে।
আদালতে বিচারের সময় আমাঘলোবেলি বিরোধীদের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আপনাদের নিজেদের সামর্থ্যের ওপর বিশ্বাস হারানো উচিত নয়। এখনো সময় আছে। বিজয় না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলবে।
আমাঘলোবেলি অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম বাতুমেলিবির প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, যেখানে জর্জিয়ার রাজনীতি, দুর্নীতি ও মানবাধিকার নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়। তিনি এর সহযোগী প্রকাশনা নেটগাজেটিও প্রতিষ্ঠা করেন।
গত বছরের সংসদ নির্বাচনের পর থেকে জর্জিয়ায় ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিক্ষোভ চলছে। নির্বাচনে জর্জিয়ান ড্রিম ক্ষমতা ধরে রাখলেও, বিরোধীরা নির্বাচনের ফলকে অবৈধ ঘোষণা করেছে এবং রাশিয়ার সহায়তায় ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলেছে।
এই সাখারভ পুরস্কারের কয়েকজন বিজয়ী, যেমন নেলসন ম্যান্ডেলা, মালালা ইউসুফজাই, ডেনিস মুকওয়েগে এবং নাদিয়া মুরাদ, পরবর্তীতে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। ভেনেজুয়েলার বিরোধী নেতা মারিয়া কোরিলা মাচাদো, যিনি এ মাসের শুরুতে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন, গত বছর সাখারভ পুরস্কার লাভ করেন।
৫০ হাজার ইউরোর পুরস্কার-মূল্যের এই সম্মাননা আগামী ডিসেম্বরে স্ট্রাসবার্গে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে এক অনুষ্ঠানে প্রদান করা হবে। তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস